হার্ট সুস্থ রাখবেন যেভাবে

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৩৮

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

হৃদযন্ত্রে ধ্বংস আনার উপায় রয়েছে। এই অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রের উপর অন্তর্ঘাতের শেষ তো নেই। হৃদস্বাস্থ্যের কথা যখন আসে, তখন বলতে হয় এমন কিছু জিনিষ আছে যার উপর নিয়ন্ত্রণ নাই যেমন বুড়ো হয়ে যাওয়া, মা-বাবার হৃদরোগের ইতিহাস, তবে এমন কিছু জিনিষ আছে যেগুলো বেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, আর তাই হৃদরোগের ঝুঁকিও অনেক কমানো যায়। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের মুখপাত্র এবং ইউসিএলএ’র কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: গ্রেগ ফনারা বলেন, এক্ষেত্রে এক আউন্স পরিমাণ প্রতিরোধ হলো এক পাউন্ড সমান নিরাময়ের সমতুল্য। হৃদযন্ত্রকে সজীব চলতে দিতে হলে কয়েকটি বিধিনিষেধ আছে। এগুলো মেনে চলতে হবে।

ধূমপান না করা
হৃদরোগের প্রধান কারণ হলো ধূমপান, ধূমপানে বাড়ে রক্তচাপ, রক্তে জমাটবাধা বাড়ে, ব্যায়াম করা হয়ে পড়ে শ্রমসাধ্য। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের মতে ধূমপান হলো অকাল মৃত্যুর পহেলা নম্বর প্রতিরোধযোগ্য কারণ, আমেরিকাসহ অনেক দেশেও তাই। যদিও ধূমপানের বদভ্যাস ছাড়া বেশ কঠিন, তবে একে ছাড়তে পারলে এর পুরষ্কার ও ফলাফল সর্বশ্রেষ্ঠ ও তাত্ক্ষনিক। ধূমপান ছাড়ার কয়েক দিনের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি নেমে আসে।

এক বছরের মধ্যে ঝুঁকি কমে আসে অর্ধেকে। কার্ডিওলজিস্ট ও নিউইয়র্ক ইউনির্ভাসিটি ওমেনস্হার্ট কর্মসূচীর পরিচালক ডা: নাইকা গোল্ডবার্গ বলেন, একটানা দশ বছর ধূমপান মুক্ত থাকলে অধূমপায়ীর পর্যায়ে নেমে আসা যায়।

বুকব্যথা অবহেলা না করা
হয় যদি বুক ব্যথা, কেন তা জানেন না। তাহলে অবশ্য নিতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ। ব্যায়াম করার সময় যদি বুক ব্যথা হয় তাহলে বিপদ সংকেত। অবশ্য অতিভোজনের পর ব্যথা হলে তা হতে পারে হজমের অসুবিধার জন্য। যদি মনে হয়, একটি হাতি বসে আছে বুকের উপর, শরীর সজোরে ঘেমে নেয়ে উঠছে কেউ তাহলে জরুরী সংকেত, ডাকতে হবে কার্ডিয়াক ইমার্জেন্সি। যেমনই হোক ব্যথা বুকে, ডাক্তার দেখানো জরুরি।

বংশগতিতে হৃদরোগের প্রবণতা থাকলেই ভয় পাওয়া কেন হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস হৃদরোগের বড় ও জোরালো ঝুঁকি বটে। মা-বাবার কারো যদি হৃদরোগ হয়ে থাকে তাহলে পুরুষের ঝুঁকি হয় দ্বিগুণ আর নারীর ঝুঁকি উঠে যায় ৭০%, ২০১০ সালে আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের প্রতিবেদন তাই বলে। হৃদরোগ কেবল উত্তরাধিকারের বিষয় নয়, জীবনধারাও কম বড় উপাদান নয়, বলেন গোল্ডবার্গ। এরপরও বিপর্যয় এড়ানো যায়, অন্যান্য হৃদবান্ধব কাজ কর্ম করে একে হ্রাস করা যায়। গোল্ডবার্গ বলেন, যেমন হৃদক্ষতির এলডিএল ৫০ শতাংশ কমালে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে অর্ধেকে। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশনে প্রকাশিত ১৯৯৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় কোলেস্টেরল কমাবার ওষুধ স্ট্যাটিন গ্রহণ করে পারিবারিক ইতিহাস আছে এমন লোকের ঝুঁকিও কমানো যায়। কখনও এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঝুঁকি নিশ্চিহ্ন করাও সম্ভব। শেষ কথা; পারিবারিক ইতিহাসকে নিজের ভবিতব্য নির্ধারণে ছেড়ে দেওয়া ঠিকনা।

কখনও চেকআপ করা বাদ দেওয়া যাবে না
ডাক্তারকে দিয়ে নিয়মিত চেকআপ করালে বোঝাই যাবেনা যে এমন নীরব কিছু হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে যা সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা বেশ কঠিনই, আনমানসন-ইউসিএল এ কার্ডিওমায়োপ্যাথি সেন্টারের পরিচালক ফনারোর বক্তব্য। সবচেয়ে সচরাচর অথচ উপসর্গহীন হৃদরোগ ইস্যু সবচেয়ে সহজে চিকিৎসাযোগ্য, যেমন- উচু রক্তচাপ ও উচুমান কোলেস্টেরল।

গোল আলুর মত শরীর হলে বিপত্তি
শুয়ে বসে জীবন কাটালে বাড়ে হৃদঝুঁকি। শরীরচর্চায় বাড়ে আয়ু ও সজীব হয় দীর্ঘ জীবন। ব্যায়ামে কমে রক্তচাপ, কোলেস্টেরলও কমাতে সাহায্য করে, ওজন হ্রাসে সহায়তা হয়, কাজকর্মে চলে আসে সচলতা, কমে মানসিক চাপ। গত ২০ বছর ব্যায়াম না করলেও চিন্তা নাই, এখনই শুরু করলে হলো। শুধু ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত শুরু করার আগে, কেমন ফিটন্যাস প্রোগ্রাম নিতে হবে।

ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ নিয়মিত নিতে হবে হূদসমস্যার জন্য ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিলে অবিলম্বে সমস্যা নাও হতে পারে কিন্তু পরে বড় বিপর্যয়ের জন্য তৈরি থাকতে হবে। হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক হলেই কেবল এর প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়, হায়রে! কোলেস্টেরল কমাবার স্ট্যাটিন খাওয়া বন্ধ করলাম কেন? হৃদসমস্যায় ওষুধ পত্রকে দেখা উচিত হৃদরোগ ও স্ট্রোকের বিরুদ্ধে ইনসুরেন্সের মত, বলেন ফোনারো।

তলপেট বাড়ছে, কোমরের বেড় বাড়ছে, পেটের ঘের বাড়ছে, এটাকে মোটেই অবহেলা নয়। বেল্টের সাইজ বড়ো হচ্ছে, এটি ভাবনার কথা। তলপেটে মেদ, আপেলের মত অবয়ব হলে সংকেত দেয় শরীরে হলো ‘মেটাবলিক সিনড্রোম।’

মেটাবলিক সিনড্রোম হলো হৃদরোগের ঝুঁকি সমষ্টি, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকি। ধমনী হয়ে উঠে কঠিন, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও প্রদাহ সব মিলে বিশাল ঝুঁকি। বিশাল কোমর রেখা হলে হৃদরোগের ঝুঁকি হয় দ্বিগুণ। তাই স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে ফিরিয়ে আনতে হবে চিকন কোমর।

হৃদযন্ত্রে অনিয়মে কমন বিশৃঙ্খলা খেয়াল করুন
হৃদযন্ত্রে স্পন্দনে অনিয়ম, সঙ্গে বুকে অস্বস্থি, শ্বাসকষ্ট,মুর্ছার উপক্রম হতে পারে হৃদছন্দে চ্যুতির লক্ষণ। এহলো হৃদযন্ত্রে তড়িৎ পরিবহনে অনিয়ম, তাই স্পন্দন হয় খুব দ্রুত, নয়ত খুব ধীর, নয়ত অনিয়মিত। তবে হঠাৎ তেমন অনিয়ম, মুহুর্তের জন্য চলেও গেলো, এতে ভাবনা নেই; চকলেট খেলে, কফি খেলে, কোনও কোনও ওষুধ খেলে, ঠাণ্ডা লাগলে এমন তাৎক্ষণিক সমস্যাও হতে পারে। তবে বারবার এমন হলে সমস্যা অন্যান্য থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্য।

রক্তচাপ থাকবে নিয়ন্ত্রণে রক্তচাপ বেশি থাকলে একে চিকিৎসা না করা হলে হৃদরোগ হতে পারে। উন্নতদেশেও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের মাত্র অর্ধেক নিজেদের রক্তচাপ রাখেন নিয়ন্ত্রণে। কি শৈথিল্য! রক্তচাপকে অবাধে বেড়ে যেতে দিলে, হাতছাড়া হতে দিলে হার্টকে আরও কঠোর শ্রম করতে হয় পাম্প করার জন্য। পরে হৃদনিষ্ক্রিয়া, ধমনীও হয়ে পড়ে কঠিন। পরবর্তীতে হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক। উচ্চরক্তচাপের উপসর্গ তেমন নাই, তবে একে নির্ণয় করা বড় সহজ। ডাক্তারের চেম্বারে চেক আপ, এমনকি নিজ ঘরেও হোম ব্লাড প্রেসার মনিটর দিয়ে, খাদ্য বিধি, ব্যায়াম, প্রয়োজনে ওষুধ চিকিৎসা রক্তচাপের জন্য।

পরিমিত আহার প্রচুর খেলে ঝুঁকি বাড়ে। শরীরের ওজন বেশি হলে বা স্থূল হলে হৃদরোগ, হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। স্বল্পায়ু হতেই পারা যায়। এতো জানা ওজন কমানো বেশ কঠিন। তবে মাঝারি হ্রাস করলেও বেশ লাভ। তাই প্রচুর ফল, শাক সবজি, বাদাম, কম চর্বি ও কোলেস্টেরল, ট্রান্সফ্যাট একেবারেই নয়। তবে এসব চর্বি বাদ দিতে হবে কেন? চর্বি আছে মাছে, জলপাই তেলে, বাদামে বেশ হৃদবান্ধব, তবে খেতে হবে পরিমিত।

লেখক: পরিচালক, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস বারডেম, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ: ইত্তেফাক, ২৬ আগস্ট, ২০১৭

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত