শুন্য-ছাড়া, জোড়ের পাহাড়

খুঁটির জোর বুঝেনি ‘হমানেরা’

প্রকাশ | ১৯ জুন ২০১৭, ২১:১৬

‘হে পাহাড় তোমার বুকে কোদাল মেরে খুঁড়ে আমি রাস্তা ও বাড়ি বানাবো, উন্নয়ন করবো, তোমার গাছ কাটবো, প্রকৃতিকে ধ্বংস করবো। তুমি কিছু মনে করো না’- বাঙালি সেটেলার যারা পাহাড়ে বাড়ি বানিয়েছেন তারা এভাবে কি পাহাড়ের অনুমতি নিয়ে থাকে?

পাঠক, এই প্রশ্নের উত্তর পরেই জানাতে পারবেন তবে ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ফিরে আসার পর- ১৩ জুন পাহাড়ধসে তিন পার্বত্য জেলা ও চট্টগ্রামে প্রায় দেড়’শ মানুষ প্রাণ হারান। এর মধ্যে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য রয়েছেন। দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ সহনশীল পাহাড়িরা কঠিন যুদ্ধে নেমেছে সেই ১৯৮১ সালের পর থেকেই। এবার আরো ভয়াবহ পরিণতি হয়তো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্ছেদের বেদনা সইতে সইতে পাহাড়িরা এখন আবারো অজানা এক শঙ্কায় পড়েছেন। 

কথায় আছে, ‘দাঁড়িওয়ালা খেয়ে গেছে মোচওয়ালা ফেঁসে গেছে’। অনেকটা সেরকমই শত বছরের আদি পাহাড়িরা বাঙালির রাক্ষুসে স্বভাবের কারণে এখন নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে টানপোড়নে পড়তে যাচ্ছেন। যে হারে এখন চারিদিকে পাহাড় ও পাহাড়ি বাড়ি বিশেষজ্ঞ খোঁজ মিলছে, ভাবছি আরো আগে তাদের পাওয়া গেলে মন্দ হতো না। তাহলে এত মানুষের প্রাণহানি হয়তো ঘটতো না। সকলেই এখন আওয়াজ তুলছেন প্রশাসন কেন পাহাড়ে বাড়ি নির্মাণে নীতিমালা তৈরি করেনি বা করছে না? তবে আমি অবশ্য এসব নীতিবাক্যের পেছনে ছুটতে চাই না।

আমি সরাসরি বলতে চাই, বারবার এই পাহাড়ধস কখনোই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। দিনের পর দিন পাহাড়ের জীবনে 'হমান-মানুষের' হস্তক্ষেপের কারণেই আজ জীবনের বিনিময়ে মূল্যশোধ করতে হচ্ছে নিরপরাধ মানুষকে। উঁচু বা বিশাল দেহের মাটির সবুজে বা পাথুরে ডিব্বা- পাহাড়েরও জীবন আছে। পাহাড়ি এলাকায় আমার জন্ম, ছোট থেকেই পাহাড়, নদী ও সমুদ্র দেখেই বড় হয়েছি। সে সময়ের পাহাড় আর এই সময়ের পাহাড়ে ব্যাপক গড়মিল। তখন দেখতাম বিশাল সবুজে পাহাড় আকাশ ছুঁতে যাচ্ছে। খুব লোভ হতো বড় পাহাড় দেখলে ইস যদি সেখানে উঠলে আকাশ ছোঁয়া যেতো! আর এখন গেলে দেখি, ন্যাড়া পাহাড়, দিন দিন সমতলের মাটিতে মিশে যাচ্ছে। আর এই মিশানোর দায়িত্ব নিতে কেউই পিছনা হয়নি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে মনু মিয়া, কালু মিয়াসহ সকলেই।

গত কয়েক মাস আগে রুমা খালের পাথর উত্তোলনের ছবি আমরা দেখেছি। পাহাড়ের ভিত পাথর তুলে রাস্তা তৈরির কাজ করছে খোদ নিরাপত্তাবাহিনী। এতে করে পাহাড়ের ভিত দিন দিন আলগা হচ্ছে যেমন, তেমনিভাবে গাছ-গাছালি কেটে পাহাড় ‘হমান’ বা ‘সমান’ করাও আজকের এই ধসের অন্যতম কারণ। 

মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবখানেই শুনছি- বৃষ্টির কারণে নাকি পাহাড় ধস হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত শত বছর ধরে আদি পাহাড়ি মানুষেরা তো সেখানে বসবাস করে আসছেন, তাহলে এখন কেন এত শত বছর শুনিনি পাহাড় ধসের কথা? কেন গত কুড়ি বছর ধরে ধসে জীবন নাশ হচ্ছে?- পাঠক প্রশ্নের উত্তর লেখাতেই পাবেন, যাই হোক যা বলতে লিখা। 

গত ৩০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার পাহাড় কাটা হয়েছে। নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে শতাধিক ছোট-বড় পাহাড়। আর প্রতিবার ধসের কারণ জানতে গঠন হয় কমিটি। এখানেও প্রশ্ন- কমিটিগুলোতে যারা থাকেন তাদের যোগ্যতা কি? তারা কখনো পাহাড়ে গিয়েছিলেন? জানেন কি পাহাড়ি কোনো পাড়ার নাম? কিন্তু ঠিকই লিখেই গেছেন শত সুপারিশই!

পাহাড়ে কাজ করার সুবাদে পাহাড়ের মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা জনগোষ্ঠীর সাথে নানা সময়ে তাদের জীবন যাত্রা নিয়ে কথা বলেছিলাম। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল তাদের বাড়িগুলো কেন খুঁটির ওপর? উত্তরে সেই মানুষেরা বলেছিলেন, এটা প্রাকৃতিক পদ্ধতি? আমি একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করি কিভাবে? বান্দারবনের এক প্রবীণ মারমা নারী বলেছিলেন, খুঁটি করার ফলে পাহাড়ের মাটির ওপর চাপ কম পড়ে। এতে বৃষ্টিতে মাটি আলগা হয়ে পাহাড় ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে না।

শুরুতেই প্রশ্ন ছিল বাঙালিরা পাহাড়ের অনুমতি নেয় কিনা, এক কথায় ‘না’। তবে পাহাড়িরা, যাদের শত’বছরের আবাস তারা কিন্তু ঠিকই অনুমতি নেন- তারা যখন বসবাসের ঘর তৈরি করেন ও জুম চাষের জন্য পাহাড়রে জমি নির্বাচন করেন, তারা পাহাড়ের কাছ থেকে অনুমতি নেন। এবং প্রার্থনার মাধ্যমে পাহাড়কে জানান, ‘হে পাহাড় তুমি কষ্ট নিও না, বেঁচে থাকার জন্য আমরা তোমার গাছ কাটবো, পোকামাকড় ধ্বংস করবো, পাহাড় তোমার গায়ে আগুন দেবো। এবছরের মতো আমাদের ক্ষমা করো। পরের বছর আর এই জমিতে আঘাত দেবো না’।

বাংলাদেশে আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আমার প্রশ্ন তাদের কাছে, কখনো কি জেনেছেন পাহাড়ে বাড়ি করার ক্ষেত্রে পাহাড়ি বিজ্ঞান? জানতে চেয়েছেন কি যে খুঁটির ওপর বাড়ি করা হয়, কতটি খুঁটির প্রয়োজন পড়ে? কয় হাত হয় একেকটি পাহাড়ি বাড়ি? এই যে পাহাড়ের মাটিতে চাপ কম রেখে বাড়ি তৈরি করার পদ্ধতি কি আপনারদের জানা ছিল? ধরলাম জানা ছিল, তাহলে কি করে আপনারা পাহাড়ের ঢালে বা পাদদেশে রড, ইট, সিমেন্টে ঢালাই দিয়ে রিসোর্ট বা হোটেল তৈরির পরিকল্পনা দিলেন?

সমতলের মানুষ যখন থেকে পাহাড়ে গেলো তখন থেকেই পাহাড়কে হমান বা সমান বানিয়ে আসছে, এখনো তাই-ই করা হচ্ছে। পাহাড়ের গাছপালার চরিত্র কেমন তা জেনেই সমতলের বীজ বা চারা পাহাড়ে রোপণ করে দেয়া হয়েছে দিনকে দিন। শুধু কি তাই? পাহাড় সমতল বানানোর চর তৈরীও করা হয়েছে সমতলের আদলের ঘরবাড়ি। গত আট বছরে পাহাড় ধসে ৪৩ ভাগ বাঙালি মারা গেছে, আদিবাসিদের সংখ্যা ২৪ ভাগ। মাটিতলে চাপা পড়াদের সংখ্যা তো অগুনিত। অন্যদিকে যারা শত বছর ধরে দুর্গম পাহাড়ে বসবাস করে আসছেন পাহাড়ের শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তারা জানেন কোন পাহাড়ে বাড়ি বানাতে হয় বা কেমন হয় ওই পাহাড়ের মাটি চরিত্র। 

পাহাড়ের মাঝে বা ঢালে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাড়িগুলো খুঁটির ওপরই নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়িদের বিজ্ঞান, যে তথ্যটি পাহাড়ি বন্ধুদের কাছ থেকে জেনেছি, পাহাড়ে সব সময় জোড় সংখ্যার নিয়মে বাড়ি বানান প্রাচীন পাহাড়ি মানুষেরা। যেমন ১২ হাত একটি বাড়ি হলে সেখানে খুঁটি থাকে ৮টি, ১৬ হাত হলে খুঁটি খাকে ১০টি। এভাবে যত হাত বাড়ি তত বাড়ানো হয় খুঁটির সংখ্যাও। এ হলো বসবাসের জন্য তৈরি করা বাড়ির খুঁটির সংখ্যা। যেখানে রান্না করা হয় বা যে ঘরে সারা বছরের জুমের ধান বা খাবার সংরক্ষিত রাখেন তারা সেই বাড়িতে খুঁটি খাকে ৮টি। পাহাড়িরা কখনোই শুন্য শুন্য ব্যবহার করে বাড়ি তৈরি করেন না, যেমন- দশ হাত, ২০ হাত ইত্যাদি। 

একজন প্রবীণ পাহাড়ি বন্ধুর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম কেন খুঁটি? হমান কেন নয়?- উত্তরে তিনিও সেই মারমা নারীর মতোই বলেছিলেন, তাদের বিজ্ঞানের কথা। তার তথ্য মতে, এতে মাটির ওপর চাপ কম পড়ে_! ফলে বর্ষায় বা ভারী বর্ষণে অথবা পাহাড়ি ঢল আসলে মাটির ওপর চাপ কম পড়ার কারণে তাদের বাড়ি ও সম্পদ রক্ষা পায়। 

কিন্তু রাজনৈতিক গ্যারাকলে সেটেলার বাঙালি বা প্রশাসনের বস্তপঁচা অজ্ঞ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে রড, সিমেন্ট, ইট-বালু দিয়ে পাহাড়ের ওপর বোঝা চাপিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে আসছিল এতদিন। কিন্তু আর কতো- নদী, সাগর বা অন্যান্য প্রাণীর মতো পাহাড়েরও তো জীবন আছে, হাজার বছরে যে জীবন শুধু বৃদ্ধি হয়েছে- গাছ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য, যা বুঝেনি রাক্ষুসে মানুষ।  
  
লেখক: পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও পাহাড় বিষয়ক সাংবাদিক