রূপময় ঋতু বর্ষা শুরু

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০১৭, ১৫:৪৪

জাগরণীয়া ডেস্ক

রূপময় ঋতু বর্ষার প্রথমদিন আজ
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতায় লাইন দিয়ে বর্ষা বরণ। 

গ্রীষ্মের অগ্নিঝরা দিনগুলো যখন প্রকৃতিকে করে বিবর্ণ ও শুষ্ক এবং জনজীবনকে করে অসহনীয়, তখনই বর্ষা রিমঝিম বৃষ্টিতে প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব। বর্ষার মুষলধারার বৃষ্টিতে ভেজার জন্য তাই তৃষ্ণি অপেক্ষাতুর প্রকৃতি উন্মুখ হয়ে আছে। আজ ১ আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বর্ষার প্রথম দিন।

বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা বর্ষাকে অভিহিত করেন ‘সেকেন্ড সামার’ হিসেবে। মৌসুমি বায়ু প্রবাহের কারণে টানা দুই মাস থেকে থেকে বৃষ্টিপাত, প্রকৃতি অন্য রকম এক আদলে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। তবুও বর্ষাই ঋতুর রানী।

‘বাদল-দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’ বর্ষা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আবেগময়, প্রেমসিক্ত গান শুধু বাঙালিদের জন্যই প্রযোজ্য। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত বহু কবিই বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মোহিত ও মুগ্ধ, বর্ষার আবাহনে উচ্ছ্বসিত ও মুখর। বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। বর্ষা ঋতু তার বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বতন্ত্র। বর্ষা ঋতু কাব্যময়, প্রেমময়। 

বর্ষার প্রবল বর্ষণে নির্জনে ভালোবাসার সাধ জাগে, চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। শত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভিড়েও কোথায় যেন মেলে এক চিলতে বিশুদ্ধ সুখ। কদম ফুলের মতো তুলতুলে নরম, রঙিন স্বপ্ন দুই চোখের কোণে ভেসে ওঠে, ঠিক যেমন করে আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়।

বর্ষা ফুল ফোটায়। বর্ষার এই শীতল আবহাওয়ায় গাছে গাছে কদম ফুলের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বর্ষার প্রথম মাস আষাঢ়ের অগ্রদূত কদমফুল। যেন কদমফুল আষাঢ়কে স্বাগত জানায়। বর্ষার আগেই গাছে গাছে কদমফুল ফুঠেছে।

বর্ষা কবিদের ঋতু। বর্ষা নিয়ে কবিরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা-গল্প-গান। বর্ষা মানেই সময়-অসময়ে ঝমাঝম বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, খাল-বিলে থইথই পানি, নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পালতোলা নৌকার সারি। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল তমাল শাল পিয়াল আর মরাল কপোতের বন বীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।

রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষামঙ্গল’ এবং কালীদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের কথা উল্লেখ না করলে বর্ষা ঋতুর স্বাদই অপূর্ণ থেকে যাবে। 
রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’-এর পাতায় পাতায় ভরে আছে বর্ষার ঘনঘটা, গুরুগম্ভীর বৃষ্টির কথা। রোমান্টিক ঋতু বর্ষাকাল; এবং এই ঋতু বাঙালির একান্ত নিজস্ব। ‘বর্ষণমুখর সন্ধ্যা বা বৃষ্টিভেজা রাত’ বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও মিলবে না। শীতপ্রধান দেশে কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কবিরা বর্ষার সঙ্গে পরিচিতই নন। কবিগুরু বলেছেন, ‘এমন দিন তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

মহাকবি কালীদাস তার ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহকাতর ‘যক্ষ মেঘ’কে দূত করে কৈলাসে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সেই বিরহ বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহকাতর চিত্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে। তাই রবীন্দ্রনাথ কালীদাসের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘কবির কবে কোন আষাঢ়ের পুণ্য দিবসে লিখেছিলে মেঘদূত। বৃষ্টির শব্দে যক্ষের মতোই বাঙালির হৃদয় এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কেতকীর মন মাতানো সুগন্ধ আর কদম ফুলের চোখ জুড়ানো শোভা অনুষঙ্গ হয়ে আছে আষাঢ়ের। কদম কেতকী ফুটবে, আকাশজুড়ে চলবে মেঘের আনাগোনা, দ্রিমিকি দ্রিমিকি রবে।’ এমন দিনে ‘মুহূর্তে আকাশ ঘিরি রচিল সজল মেঘস্তরদ আর তাতে রিক্ত যত নদীপথ’ ভরে যাবে ‘অমৃতপ্রবাহে’। মরুবক্ষে তৃণরাজি/পেতে দিল আজি/শ্যাম আস্তরণ। গুরুগুরু মেঘ গর্জে ভরিয়া উঠিল বিশ্বময়। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি’। আষাঢ়ে জলভারানত ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশি আকাশ ছেয়ে রাখে। কখনো বা ‘প্রাণনাথ’-এর মতো প্রকৃতিতে নামে বারিধারা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত