বিলুপ্তপ্রায় শালবন

প্রকাশ | ০৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:১৬

আনিসুজ্জামান খান
বিপন্ন এই বিশ্বে সর্ববৃহৎ বদ্বীপ, আমাদের দেশ বাংলাদেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অশনি সংকেতে এক মহবিপদাপন্ন অবস্থায় বিরাজ করছে। আবহাওয়ায় অযাচিত পরিবর্তন ঋতু বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। দেখা দিয়েছে অকাল বন্যা, মাহাপ্লাবন, খরা, ঝড়-ঞ্ঝা, ভূমিকম্প এবং জলোচ্ছাস। এর পরিণতিতে বদ্বীপ প্রকৃতি এবং এর উপর নির্ভরশীল, কৃষি, মৎস্য, বৃক্ষ তরুলতাসহ সকল জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত প্রায়। সমাজ, সভ্যতা ও জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্র সবই আজ এক নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা এবং হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে। ‘দেশ ছেড়ে পালাতে পারলেই বাঁচি’ প্রতিনিয়তই দ্বিধাগ্রস্ত মানব মনে পুষে রাখা এই মনভারী মানুষের মিছিল দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে। এর মূল কারণ সুদূর প্রসারী বিজ্ঞানসম্মত সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তার সর্বাঙ্গীণ বাস্তবায়নের অভাব।
 
পাঁচশালা এবং প্রকল্পভিত্তিক একপেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা এর প্রকৃষ্ট নমুনা। প্রাকৃতিক নবায়নযোগ্য এবং অনবায়নযোগ্য সম্পদ লুন্ঠন এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ভিত্তিতেই ধস নামিয়েছে। যেমন বনসম্পদ। সরকারী হিসেব অনুযায়ী এদেশের ভূমির ১৭ থেকে ২০ ভাগ বনভূমি যা স্বাভাবিক অর্থেই বনাচ্ছাদিত থাকার কথা। অথচ বাস্তবে তা আছে অর্ধেকেরও কম। এর জন্য কোন জরিপ বা গবেষণার কোনই প্রয়োজন নেই। দেশের মানচিত্রে স্বাধীনতাপূর্ব শালবন আচ্ছাদন এবং বিস্তৃতি ও বর্তমান অবস্থা তুলনা করলে লুন্ঠনের ভায়াবহতা সন্ধাতারার মত নির্ণায়ক হিসেবে ফুটে ওঠে। মধুপুর গড়কে এখন আর মধুপুর শালবন বলা যাবে না। মধুপুর আনারস, কচু, ঘেচুর খামার বলা যথোপযুক্ত হবে। শালবন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম স্থান। হিমালয় পাদদেশ, জয়ন্তিয়া, গারো-খাসি পাহাড় ছেয়ে এর বিস্তার ঘটে, বরেন্দ্রভুমি, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, মধুপুর গড়, ভওয়াল গড়, শালবন পেরিয়ে ময়নামতি পর্যন্ত।
 
প্রতিবেশ বিজ্ঞানে ‘ডেসিডিওয়াস বন’ হিসেবে এর পরিচিতি, আর আমরা চিনে থাকি শাল-গজরী বা ঝরাপাতার বন হিসেবে। এই বনের অন্যতম প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো বনের সকল বৃক্ষের পত্র-পল্লব এক সাথে ঝরে যায়। শাল, হরিতকী, বহেরা, জাম, শটি, আমলকি, টেন্ডু, আইন, বেত, চালতা সমৃদ্ধ শাল বনাঞ্চল ৫০০-র অধিক ঝরাপাতার বৃক্ষ প্রজাতির এক অনবদ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের সুশৃঙ্খলিত প্রতিবেশ প্রণালীর সৃষ্টি করে। সেই শাল বন বক্ষে ধারণ করেছিল বাংলার অপরূপ প্রাণীবিচিত্র্য ভান্ডার। যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
 
স্তন্যপায়ী প্রাণী: নীলগাই, বারসিংগা, বুনো মহিষ, হাতী, বানর, হনুমান, গন্ডার, বাঘ, চিতাবাঘ, মায়াহরিণ, গন্ধগকুল, শুকুর, বাগডাস, বনবিড়াল, চিতা বিড়াল, শেয়াল, বেজী, ভোদড়, সজারু, পিপীলিকাভুক, খরগোস এবং বহু প্রজাতির বাদর।
 
পক্ষীকুল: ধনেষ, হাড়গিলা, সারস, নলঘোংগা, শকুন, হরবোলা, তোতা, শ্যামা, শাহীবুলবুল, শিপাহী বুলবুল, ময়ূর, কাঠময়ুর, মনভূলানী, বনপরী, মধুকাঠরে, বাঁশ ঠাকুর, বসন্ত বাউরী, চাতক, লাল লতিকা, হটাটিটি, ভুবনচিল, মাছমুরাল, শেখ ফরিদ, ফ্লরিক্যান, কালো তিতির, শাহীফ্যালকন, সাঁতারে পানকৌড়ি, বালি হাঁস এবং অসংখ্য বুনো পাখ-পাখালী।
 
সরীসৃপ: অজগর, রাজগখুর, শঙচূড়, ফানুষ ব্যাঙ, চন্দ্রবোড়া, পাহাড়ী কচ্ছপ, হলদে কাঠা, হ্যামিল্টন্স, জলার কচ্ছপ, হুরীম কচ্ছপ, লৌহপৃষ্ঠ কচ্ছপ, রক্তচোষা, সোনা গুই, টিকটিকি, গিরগিটি ইত্যাদি।
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো এই বুনোবৈচিত্রের বেশিরভাগ প্রজাতিই স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত। বাকিরা বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ধুকে ধুকে টিকে আছে।
এই যে গণহারে প্রজাতি বিলুপ্তি এবং বন উজাড়-পরিবেশের ক্ষতিকারক প্রভাব কি? এর উত্তর দিবালোকের মতই স্পষ্ট।
 
শালবন জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হওয়ায়:
• দেশ হারিয়েছে জীবজ সম্পদ ভান্ডার
• ভূমি উর্বরতা হারিয়ে বন্ধা হয়ে যাচ্ছে
• ভূমি ধ্বংস এবং নদী ভরাট হচ্ছে
• শুস্ক মৌসুমে মাত্রারিক্ত খরা এবং মহামারী দেখা দিচ্ছে
• ক্ষতিকারক কীট পতঙ্গের বিস্তার হচ্ছে
• গবাদিপশুর খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে
• গৃহ নির্মাণ সামগ্রীর দুস্প্রাপ্যতা লক্ষণীয়
• বনভূমি দখল এবং বনবিবর্জিত অপরাপর কর্মকান্ডে ব্যবহার হচ্ছে
• হাজারো প্রয়োজনীয় বনজ দ্রব্যাদি যেমন, বাঁশ, বেত, কাঠ, খাদ্য, ফুল, ফল, বনৌষধি গাছ, লতা-পাতার উৎস বিনষ্ট হয়ে যাওয়া।
সর্বোপরি এই বিলুপ্তি স্থানীয় আবহাওয়া এবং ঋতুবৈচিত্র্যে অযাচিত ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে। বনজ জীবসম্পদের উৎস লুপ্ত হয়ে মানুষের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
 
এই বিপর্যয় কেন?
এর উত্তর বেশ জটিল। বন সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ বলে থাকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জনসাধারণ কর্তৃক বনজ সম্পদ আহরণ শাল বন ধ্বংসের কারণ। অপরদিকে জনমত হলো-
বন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারী রাজস্য খাত হতে এক বিশাল বিভাগ, তার যুগপোযোগী আইন, অর্থবল, অস্ত্রবল, গবেষণা ইনষ্টিটিউট, কলেজ, আবাস, নিবাস, বিদেশী ঋণের বিশাল অঙ্কের প্রকল্প সহায়তা দেয়া হলো। যোগযোগের আধুনিক যানবাহন ইত্যাদি হাজারো সুযোগ সুাবিধাসহ ১৭ ভাগ ভূমি দেওয়া হলো বনবিভাগকে। বিনিময়ে বনবিভাগ জাতীয় রাজস্বে কি দিল? কত ভাগ বন রক্ষা হলো? কত ভাগ ধন উৎপাদন হলো? দাঁড়ি-পাল্লায় মাপযোক হলে কি অবস্থা দাড়ায়?
 
কে এই বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডারকে উজার করলো? তার হিসেব নিকাশ প্রয়োজন। জনসাধারণ আজ এই দাবী তুলছে। কেবল মাত্র সুন্দরবনের অংশবিশেষ বাদ দিলে বাংলাদেশের সকল বনাঞ্চলই লুন্ঠিত হয়েছে। হাওর জলাঞ্চলের জলার বন সম্পূর্ণরূপে মূলোৎপাঠিত। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের চিরহরিৎ বনাঞ্চল কঙ্কালসার। প্রাকৃতিভাবে বিবর্তিত কয়েক হাজার প্রজাতির বৃক্ষ-তরুলতা এবং অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ চিরসবুজ বন প্রাকৃতিক ঐতিহ্য এবং ঐশ্বর্য সবই লুন্ঠিত হয়েছে এদেশের উত্তর এবং দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় চিরহরিৎ বন হতে। এই বন চিরহরিৎ বন ব্যর্থ হচ্ছে বনের আদরণীয় বুনো জীব, পশু পাখির শরীরকে তার বৃক্ষ আচ্ছাদনে ঢাকতে। বুনো হাতি, বানর, হনুমান, হরিণ-ভালুক, খোলা প্রান্তরে মানুষের মুখোমুখি, পাজিত হচ্ছে তারা, বুনো মহিষ, গন্ডার, বারসিংগার মতোই মৃত্যুকে বরণ করে এই উন্নত সভ্যতা এবং মানুষের দিকে নির্বাক স্বজনের ব্যথ্যায় নীল করুণ আকুতিতে চেয়ে আছে।
 
একদিকে বৃক্ষ তরুলতা এবং বন-বনানী যেমন ধ্বংস হয়েছে তেমনি বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কার্যকরী সংগঠন নেই। তাই এতিমদের মতো অনাদরে রয়েছে এদেশের বন্যপ্রাণী। তাদের চেয়েও এদের দুরাবস্থা বেহাল। কারণ এতিমদেরও আছে এতিমখানা। এর ফলশ্রুতিতে বৃহত্তর স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী প্রায় সকলেই মহাবিপদাপন্ন এবং বিলুপ্ত প্রায়। এই তালিকায় রয়েছে, এশিয়ান হাতী, বাঘ, ভালুক, হরিণ, চিতাবাঘ, বন ছাগল, উল্লুক। কার্যকরী জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে এই শতকেই বাংলাদেশ থেকে এদের বিলুপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও বিপদাপন্ন বন্যপ্রাণীর তালিকায় রয়েছে কয়েকশত বন্যপ্রাণীর নাম। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রজাতিসমূহ হলো-
 
অমেরুদন্ডী বন্যপ্রাণী
• ৬০ প্রজাতির প্রবাল
• ২০ প্রজাতির ঝিনুক-শামুক
• ১০ প্রজাতির কাকড়া, চিংড়ী এবং লবষ্টার
• ৪০ প্রজাতির প্রজাপতি ও অন্যান্য উপকারী মৌমাছি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি।
 
অমেরুদন্ডী প্রাণী
মৎস্য প্রজাতি: মহাশোল, বাঘাইর, আইর, মৃগেল. কালিবাউশ, গজার, রিটা, সরপুটি, শিলং।
উভচর:: সবুজ ব্যাঙ, ভেপু ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ।
সরীসৃপ: কুমির, ঘড়িয়াল, বোস্তামী কাছিম, অজগর।
পক্ষী: রাজধনেশ, লোহারজঙ্গ, শুভ্র ডানার হাঁস, রাজহাঁস, মহাকায় বলাকা, পলাশ ইগল।
 
এই বিপর্যয় এবং ব্যার্থতার দায়দায়িত্ব কার?
বন ও বন্যপ্রাণীর শতকরা ১০০ ভাগ মালিকানা সরকারী বিভাগের। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নিমিত্তে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। তালিকা প্রণীত হয় সংরক্ষিত বন্যপ্রাণীর ডজন খানের অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান, শিকার সংরক্ষণ অঞ্চল; সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। হরেক রকম প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়। তাবে তা বেশিরভাগই কাগুজে। বন্যপ্রাণী আইন বাস্তবায়ন এবং বন্যপ্রাণী দেখভাল করার জন্য সরকারী পূর্ণাঙ্গ কোন সংগঠন নেই।
 
প্রয়াশঃই বন্যপ্রাণী নিধন এবং তাদের আবাসন ধ্বংসের দায় দায়িত্ব জনসাধারণের উপর চাপানো হয়। জনসাধারণকে দায়ী করা হয়। এই দোষারোপ ভ্রান্ত এবং অন্যায়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ বন্যপ্রাণীর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। এর প্রমাণ মেলে দেশের গ্রামে-গঞ্জের ঝোপঝাড়, বসতবাড়ির বন এবং বন্য প্রাণীর সহজলভ্যতা দেখে। এমন কোন গ্রাম পাওয়া ভার যার বাড়ি-ঘর বৃক্ষ তরু-লতা আচ্ছাদিত নয়। বাড়িতে পাখপাখালির বাসা নেই, সাপ, ব্যাঙ, গুই, টিকটিকি নেই। বাড়ির পেছনে বেতবন, বাঁশ ঝাড়, হাজামজা পুকুর ও তার তীরে ঝোপ-ঝাড় হরেক প্রজাতির বুনো জীব-জন্তুর নিরাপদ আশ্রয়। আগের গ্রামীণ বনের ঘনত্ব ও নিড়াবতা না থাকলেও গ্রামীণ বৃক্ষ তরুলতাদির কমতি নেই। এর প্রমাণ মেলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে।
 
এক্ষেত্রে গ্রামীণ জলাভূমি যেমন ছোট বিল, খালা খন্দ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ব্যাপকভাবে। এর জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃষি সম্প্রসারণ এবং মৎস্য চাষ কার্যক্রমের একপাশে নীতিমালা বহুলাংশে দায়ী। যার পরিণতিতে স্থানীয় জলাভূমির জীববৈচিত্র্য ভান্ডার থেকে অনেক প্রজাতির বুনো ফসলের বীজ, মাছ প্রজাতি, ঝিনুক-শামুক, কচ্ছপ, সাপ, ব্যাঙ, জলজ লতাগুল্ম হারিয়ে যাচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি সেবা ও প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানব জনবসতি, ব্যাপক কৃষির প্রসার এবং নির্বিচারে বন্যপ্রাণী নিধনের কারনে গ্রামে-গঞ্জের বৃহৎ আকারের বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে আনেক আগেই। যার জন্য অনেকাংশে দায়ী গুটি কয়েক বন্যাঢ্য শিকারী যারা বন্দুকধারী। তৎপরবর্তী এদেশের বন্যপ্রাণীর সিংহভাগ বনেই সীমাবদ্ধ ছিল। উত্তরাঞ্চলীয় এবং মধ্য-অঞ্চল শালবন বাদ দিলে এদেশের সকল বনাঞ্চল থেকে অধিকাংশ জনবসতি দূরে অবস্থিত ছিল। বেশির ভাগ জনসাধারণ তাই সরাসরি এই বনাঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। তাই ঐ সকল বন ও বন্যপ্রাণী বিনাশে জনসাধারণের ভূমিকা নগন্য। ঝরা পাতা বন, গড়ান বন, সুন্দর বন, চিরহরিৎ বন, মিশ্রচিরসবুজ বন, জলার বন এই সকল বনই বন্য প্রাণীর মূল আবাস ছিল। এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সার্বিক দায়িত্ব সরকারের বন বিভাগের। এই দায়িত্ব পালনের জন্য বন বিভাগকে দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় আইন, বিধিমালা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বিশাল কাঠামোর বন সংগঠন, অর্থবল এবং সশস্ত্র লোকবল। মধুপুর বন আউষনাড়া বা অরণ্যখোলা ঢাকা, ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুপাশের দুই ইউনিয়ন যে কোন দিকেই হাঁটা শুরু করলে, ছাতার মতন ছায়ায় বনাচ্ছাদিত হয়ে কয়েক ক্রোশ ঘন বন পথ পরিক্রমণ করা যেত। আর আজ মধুপুরকে বন বলতে লজ্জা হয়। বনের সকল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং ঐশ্বর্য পদদলিত এবং বিলুপ্ত। এটি একটি Alien Invasive species এক পরীক্ষগার এবং আনারস বাগ। উন্মক্ত প্রান্তর। একদার হাজারো প্রজাপতির বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণীর বিশ্ববিখ্যাত শালবন আজ বন বিভাগের ভ্রান্ত নীতি এবং দুর্নীতির শিকারে বিলুপ্ত। একই ভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার এলাকার চির সবুজ বনাঞ্চল যেখানে বন নেই আছে শুধু ভূমি।
 
ফরেষ্ট্রী মাষ্টার প্ল্যানের তথ্য অনুযায়ী ৯০,০০০ হেক্টর সরকারী গেজেটেড শাল বনের মাত্র ১৭% ভান বন প্রাকৃতিক বনাচ্ছাদিত যা গুণগত মান খুবই নিম্নমানের। কোথাও শুধুমাত্র সড়কের ধারে এক চিলতে শাল গাছের সারি বিরাজমান বন অভ্যন্তর ধূ ধূ মাঠ এবং ধানের ক্ষেত। বাংলাদেশের শাল বনে ইতোমধ্যেই বিদেশী প্রজাতির দ্রুতফলনশীল বৃক্ষের বনায়ন কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। যেখানে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪৬.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ঋণ হিসেবে এশীয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক দিয়েছে ৪০.৯ মিলিয়ন ডলার। ইউএনডিপি অনুদান হিসেবে দিয়েছে ২.৪ মিলিয়ন ডলার। এই বিশাল ঋণের অর্থ সরকারের কর্ম তালিকা মোতাবেক নিম্নলিখিত কাজে ব্যয় হয়েছে-
 
• থানা নবায়ন এবং নার্সারী
• উডলট প্লান্টেশন
• স্ট্রীপ প্লান্টেশন
• বীজ বিতরণ
• নার্সারী তৈরি
• গবেষণা প্রশিক্ষণ এবং প্রশাসনিক ব্যয়ভার।
 
এখানে উল্লেখ্য যে, এই ব্যয় মাত্র ছয় বছরের ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। এত বিশাল আয়োজনের ফলাফল সকলের জানা। বন উজাড় প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ভিন্ন প্রজাতির আগ্রাসনে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত প্রায়। মধুপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে সামাজিক সংঘাত, ভূমির উর্বরতাহানি, পানি সংকট, পরিবেশের বিরূপ ভূমি ব্যবহার এবং স্থানীয় আবহাওয়ায় প্রতিবেশগত ক্ষতিকারক প্রভাব আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং বিকাশকে করছে ব্যাহত। মানুষ পরিবেশগত শরণার্থী হয়ে নগরের দিকে ধাবিত হচ্ছে ক্রমাগত।
 
• জাতীয় বননীত, ১৯৯৪ দেশের বন ২০ ভাগে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করে, বর্তমানে বনবিভাগের আওতাধীন ভূমির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে দেশের অপরাপর ক্ষেত্রে যেমন কৃষি, জলাভূমি, উপকুল, গ্রাম-গঞ্জ, যোগাযোগ এবং ব্যক্তিগত বসতভিটায় সর্বত্র বনবিভাগের কর্ম পরিধি বৃদ্ধির এক মহাপরিকল্পনার নীল নকশার পক্ষে ওকালতি করেছে।
• যদিও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বনবিভাগের সাংগঠনিক অপ্রতুলতা এবং অপরাগতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তথাপি জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সুষম ব্যবহার এবং এর উন্নয়নের কোনই সাংগঠনিক রূপরেখা এবং সংগঠন কাঠামো ও তার ক্ষমতায়নে প্রস্তাব করা হয় নি।
• যতটা জোর দেয়া হয়েছে বন সম্প্রসারণের ততটা তো নয়ই নূন্যতম গুরুত্ব দেয়া হয়নি বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত, ক্ষতিগ্রস্থ, সংরক্ষিত এবং প্রটেকটিভ বন পুনরুদ্ধার, পুনসংস্থাপন এবং রক্ষনাবেক্ষণের।
 
কি করা যেতে পারে?
• প্রথমত: বন সংরক্ষণ, সুষম ব্যবহার এবং উন্নয়নে বর্তমান বনদর্শন এবং তা থেকে পরিচালিত বনব্যবস্থাপনার সামন্ততান্ত্রিক এবং আমলাতান্ত্রিক একপেশে গোঁড়ামিপূর্ণ মনোবৃত্তি বদরাতে হবে।
• দ্বিতীয়ত: বনের সংজ্ঞা এমন ভাবে নির্ধারণ করা যেকানে এদেশর প্রকৃতিক ইতিহাস জীব-ভূবৈজ্ঞানিক বিবর্তন এতদঅঞ্চলের সাংস্কৃতিক সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচিত হবে।
 
ব্যবস্থাপনা শ্রেণীবিন্যাসকরণ: যেমন
• পরিবেশ প্রতিনিধিকারী সংরক্ষিত বন বা বনজীববৈচিত্র্য ভান্ডার
• রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারী বানিজ্যিক বন
• প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম
• জলার বন
 
পরিবেশ উন্নয়ন সুষম ব্যবহার বনাঞ্চল
• বর্তমানে যতটুকু প্রাকৃতিক শালবন অবশিষ্ট রয়েছে তা জরুরি ভিত্তিতে শালবন ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা;
• সকল ক্ষতিগ্রস্থ বনাঞ্চলে অংশিদারিত্বমূলক বন পুনর্বাসন ও পুনসংস্থাপন;
• বনজসম্পদ মূল্য সংযোজন এবং বর্ধন, উৎপাদন ও ব্যবহারে সমতা বিধান;
• স্থানীয় অর্থকরী প্রজাতিভিত্তিক ক্ষুদ্র এবং মাঝারি বনশল্প স্থাপন;
• বিপন্ন বনাঞ্চল এবং দুর্লভ প্রজাতি রক্ষা এবং বিস্তারের রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মক কর্মদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন;
• বনভোজন বনপ্রমোদের সুনির্দ্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিতকরণ এবং জনকল্যাণার্থে এর সার্বিক সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি এবং সম্মানীর বিনিময়ে সেবা প্রদান;
• বনপ্রমোদের সকল গঠনমূলক সেবার মান উন্নয়ন;
• বন সংগঠনকে যুগোপযুগী আধুনিক এবং সুসংগঠিত সর্বাঙ্গীণ সংগঠন হিসেবে পুনর্গঠন করা;
• ভালো কাজে পর্যাপ্ত পুরস্কার এবং ক্ষতিকর কাজে কঠিন সাজার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করা;
• বন ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারের এবং জনপ্রতিনিধির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;
• বিশ্ব বন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সনদের জাতীয় পর্যায়ের নীতি, বিধি এবং কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন;
• সকল কর্মকান্ড সুশৃঙ্খলিত গবেষণা,জরিপ, সুমূল্যায়ন এবং প্রগতি বজায় রাখা।
 
লেখক: বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও প্রধান বিজ্ঞানী ইসাবেলা ফাউন্ডেশন