থেমে নেই তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গন

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৪৭

জাগরণীয়া ডেস্ক

লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে নদ-নদীগুলোর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। কুড়িগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রামের ভাঙ্গনসহ ৩ জেলার অন্তত ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ হাজার হাজার বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির ও আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন স্পার বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেওয়ার পাশাপাশি ওই জেলার হাতীবান্ধা উপেজলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের ধবুনী গ্রামে শহর রক্ষা বাঁধের ৮টি স্থানে ভেঙ্গে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে ধরলা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার কুলাঘাটে শহর রক্ষা বাঁধ ও হাতীবান্ধা উপজেলা তিস্তা নদীর তীরবর্তী গড্ডিমারী ইউনিয়নের তালেব মোড় এলাকার বাঁধ। লালমনিরহাট সদর উপজেলার শীবের কুঠি ও চর শীবের কুঠি এলাকাতেও ধরলা নদীর ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ দাবি প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।

কুড়িগ্রামেও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনে জেলার সদর উপজেলা রৌমারী, রাজিবপুর ও তিস্তার ভাঙ্গনে রাজারহাট উপজেলার হাজার হাজার বসত বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের বামতীরের রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গনে ইতোমধ্যে বসত-বাড়ি, সড়ক, মসজিদ, মন্দির, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ফসলী জমি নদী গর্ভে বিলিন হতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্রের অব্যাহত ভাঙ্গনে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ফারাজীপাড়া, বলদিয়াপাড়া, গারুহারাসহ পাশ্ববর্তী গ্রামের বেশ কিছু বসত বাড়ি নদের গর্ভে বিলীন হয়েছে। রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের বেশ কিছু বসত বাড়ি তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার ব্যাপী স্থায়ীভাবে ব্রহ্মপুত্রের বামতীর সংরক্ষণের কাজ এবং ২৫ কিলোমিটার ড্রেজিংসহ সাড়ে ৭শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। 

নীলফামারীতেও তিস্তা নদীর গর্ভে বিলিন হচ্ছে হাজার হাজার একর আবাদি জমি। কেড়ে নিয়েছে শত শত পরিবারের বসতভিটা। তিস্তা নদীর এ ভাঙ্গন চলছে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখরিবাড়ি, ঝুনাগাছচাঁপানী ইউনিয়নের ছাতুনামা ভেন্ডাবাড়ি। 

অপরদিকে, নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের ছাতুনামা ও ভেন্ডাবাড়িতে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার নদী ভাঙ্গনের শিকার লোকজন তাদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন। 

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান রেজ্জাকুল ইসলাম কায়েদ জানান, তার ইউনিয়নে পূর্ব ডাউয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ডাউয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া গত ১ মাসে ৩ শতাধিক বসতবাড়িসহ অসংখ্য আবাদী জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। নদী ভাঙ্গনের শিকার পরিবারগুলো বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। 

ওই উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শফিউল আলম রোকন জানান, তার ইউনিয়নে পশ্চিম হলদিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া তার ইউনিয়নে ৪ শতাধিক বসতবাড়িসহ অনেক আবাদী জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। 

কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলো হলো- ইটালুকান্দা, সাহেবের আলগা, চর গেন্দার আগলা, চরঘুঘুমারী, ঘুঘুমারী, খেরুয়ারচর, পূর্বখেরুয়ারচর, পূর্ব খেদাইমারী, উত্তর খেদাইমারী, পশ্চিম পাখিউড়া, পাখিউড়া, পশ্চিম বাগুয়ারচর, বাগুয়ারচর, বাইসপাড়া, বলদমারা, পূর্ব বলদমারা, ধনারচর, ধনারচর নতুন গ্রাম, দিগলাপাড়া, তিনতেলী।

রাজিবপুর উপজেলার শঙ্করমাদবপুর, সাজাই, চরসাজাই, বল্লাপাড়া, উত্তর কোদালকাটি, নয়ারচর, নয়ারচর বাজার, মাঠের ভিটা, লাউশালা, টাঙ্গইলাপাড়। নদের ভাঙ্গনের ফলে গ্রামের পর গ্রামের বসত বাড়ি আবাদি জমি স্কুল কলেজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ তাদের বাপ-দাদার ভিটে মাটি হারিয়ে ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে। এ সব পরিবার সব কিছু হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন উঁচু বাঁধ, অন্যের জমি ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে।

ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গন রোধে জরুরি কোন পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে রৌমারী উপজেলা পরিষদ ভবনসহ সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

লালমনিরহাটর ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলো হলো, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নসহ কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার ৩০টি গ্রাম। 

লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার জানান, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ৪টি, আদিতমারী উপজেলায় ৪টি ও হাতীবান্ধা উপজেলায় ১১টি সহ মোট ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কুড়িগ্রাম নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার লোকজন জানান, গত পাঁচ বছরে রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী উপজেলার প্রায় ৬০ হাজার পরিবার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছে। নদী ভাঙ্গন রোধ না করলে অল্প কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে রৌমারী ও রাজিবপুর নামের দুটি উপজেলা বিলীন হয়ে যাবে।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপেজলার মহিষখোচা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে গোবর্দ্ধন স্পার বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গন রক্ষায় জরুরিভাবে ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ঈদ্রিস আলী জানান, ধরলা নদীর তীরবর্তী শহর রক্ষা বাঁধটি হুমকির মুখে রয়েছে। এছাড়া শীবের কুঠি ও চর শীবের কুঠি এলাকায় প্রতিনিয়ত আবাদী জমিসহ বসতবাড়ি ধরলা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারী জেলার ডালিয়া-দোয়ানীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নদী ভাঙ্গন রোধে প্রকল্প তৈরি করে উচ্চপর্যায়ে প্রেরণ করা হয়েছে। বরাদ্দ এলে নদী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

লালমনিরহাটের সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন বলেন, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকতাদের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় করে নদী ভাঙ্গনে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি নদী ভাঙ্গনের শিকার পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত