শম্পা রেজার ভেতর বাহির

প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৬, ২৩:৫৮

শাহাদাত রাসএল

বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ঝাপটা একটু পর পর ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। আর আমার গাড়ি ছুটে চলছে উত্তরার দিকে। গন্তব্য শম্পা রেজা’র বাসা। আসলে শম্পা রেজা এমন একজন মানুষ যার সম্পর্কে বলার জন্য তার নাম অব্দি বলাই নিরাপদ, কারন তার গুনের কথা বলতে গেলে আবার পাছে কোনদিক বাদ পড়ে যায়! বলতে গেলে সঙ্গীত শিল্পী, অভিনয় শিল্পী, আবৃত্তিকার, মঞ্চশিল্পী, উপস্থাপিকা, গানের শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী এমন অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়, এর কোনটাই অতিকথন হবে না। 

আমার লক্ষ ছিলো শম্পা রেজার একটা সাক্ষাৎকার নেয়া। কিন্তু যখন তার বাসায় পৌঁছে সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু করলাম তখন সেটা আর সাক্ষাৎকার গ্রহণের অফিশিয়াল মিটিং এর চেহারায় থাকেনি, চারপাশে অজস্র বইয়ের সারিবদ্ধ সেলফ, দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ সহ সঙ্গীতের রথী-মহারথীরা। পাশে একটা বেহালা। তার সাথে পূর্বের আন্তরিকতার সুবাদে সেটা পরিনত হলো পারিবারিক মনখোলা আড্ডায়।  

শম্পা রেজা: বল কি প্রশ্ন তোর 
শা রা: শুরু করি আপনার বর্তমান ব্যস্ততার সংবাদ দিয়ে 

শম্পা রেজা: আমার সবচেয়ে বড় ব্যস্ততা স্মরণীয়াকে নিয়ে, আমার নাতনী। এখনো ওর দুই বছর বয়স হয়নি। ওকে আমি স্মরণীয়া বলে ডাকি। স্মরণীয়া আমার বন্ধু। আমার কাছে ওকে সময় দেয়াটাই আমার সবচেয়ে আনন্দের ব্যস্ততা। তারপর তো অনেক কাজ করছি অনএয়ারে যাচ্ছে এসএ টিভির পরম্পরা, মুরাদ পারভেজের একটা ডেইলিসোপ, রুলিন রহমানের একটা ডেইলিসোপ, আরও একটা ডেইলিসোপ করছি শহিদুজ্জামান সেলিমের। পাশাপাশি ঈদের একক নাটক আর মাইটিভিতে একটা প্রোগ্রাম নিয়মিত উপস্থাপনা করছি। আমি আপাতত এই কাজগুলো করে আনন্দ পাচ্ছি আর সবচেয়ে বড় কথা আমি সব কাজের আগে আমার আনন্দ খুঁজি। যেই কাজটাকে আমি ভালবাসতে পারিনা, আমি সেই কাজটা করি না। 

শা রা: আপনি তো সংস্কৃতির অনেক মাধ্যমে কাজ করেছেন। আপনার কাজের শুরুটা কোন মাধ্যম দিয়ে? 

শম্পা রেজা: দেখ আমি অনেক মাধ্যমে কাজ করেছি বিভিন্ন কারণে, আমি কিন্তু নিজেকে গানের মানুষই মনে করি। আমার শুরুটা গান দিয়ে আর আমি গানের মানুষ বলেই নিজেকে পরিচিত করতে ভালোবাসি। সেই পাঁচ বছর থেকে আমার গানের হাতেখড়ি। তারপর থেকে কোনদিন আমি গান ছাড়া থাকিনি। এখনো আমার জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ গান। তুই দেখছিস আমার বাসার চারপাশে গানের যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি এমনই...

শা রা: কবিতা আবৃত্তিতে নিয়মিত হলেন না কেন?

শম্পা রেজা: ধুর আমি কি আবৃত্তি পারি নাকি? কবিতার প্রতি এক গভীর ভালোবাসা আছে তাই মাঝেমাঝে একটু আবৃত্তি করেছি

শা রা: অবশ্য আপনার আবৃত্তি পারার দরকারই বা কি, আপনি যখন কথা বলেন তখন কথা বলার ও উচ্চারণের ধরণে আপনার প্রতিটি কথাই আবৃত্তি মনে হয়।

শম্পা রেজা: ধুর কিযে বলিস! আমি এখনো নূর ভাই’র (আসাদুজ্জামান নূর) কথা শুনলে মুগ্ধ হই, কি চমৎকার ভাবে যে কথা বলেন তিনি! শব্দ চয়ন আর বাক্য বিন্যাসে অনবদ্য। আমি ভয়েস পেয়েছি আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে। আর আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন কণ্ঠের ব্যবহার আর উচ্চারণ ছিলো আমাদের কাছে খুব মূল্যবান বিষয়। যেমন তুমি দেখবে আমাদের সময়ের যারা ধরো রিনি, মিতা, সুবর্ণা, ওদের সবার কণ্ঠের কিন্তু একটা নিজস্বতা ছিলো। কারন আমরা সবাই নিয়মিত চর্চা করতাম উচ্চারণের আর শব্দ চয়নের। কারন তুমি অভিনয় বলো সঙ্গীত বলো সব মাধ্যমেই কিন্তু তুমি নিজেকে প্রকাশ করো বা দর্শকদের কাছে তোমার বক্তব্য তুলে ধরো তোমার ভয়েস দিয়ে। তাই তোমার ভয়েসটা তো তেমন হওয়া চাই। 

শা রা: অভিনয় বা গানের ক্ষেত্রে আপনার উপর কি কারো প্রভাব আছে?

শম্পা রেজা: দেখ অভিনয় নিয়ে আমি কোনদিন চিন্তাই করিনা। কারন আমি বলেছি আমি গানের মানুষ। অভিনয়টা করার জন্য করি। তবে গানের ক্ষেত্রে আমার মায়ের প্রভাব রয়েছে যেহেতু তার হাত ধরেই আমার সঙ্গীতের সাথে পরিচয়। গানটা কেবল গলা দিয়ে গাওয়ার জিনিস না, এটা একটা জীবনাচরণ। আমার মা গানের সাধনা করতেন তিনি আমার ভেতর এই বোধটা বুনে দিয়েছিলেন। তারপর আমি আমার সঙ্গীত গুরু ধ্রুব তারা যোশির কাছে গানের তালিম নিলাম। তিনি আমার জীবনে একটা দার্শনিক প্রভাব রেখে গেলেন।

শা রা: আপনি তো আপনার ওস্তাদজির মাধ্যমে উপমহাদেশের অনেক সঙ্গীতজ্ঞের আশীর্বাদ পেয়েছেন 

শম্পা রেজা: হ্যাঁ ওস্তাদজির মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছি, গানের তালিম নিয়েছি অনেকের কাছেই। যেমন বেলায়েত খান সাহেব, আমজাদ খান সাহেব, আমির খান সাহেব, কণিকা ব্যনার্জি। কণিকা ব্যানার্জি ছিলো আমার ওস্তাদজির খুব প্রিয় ছাত্রী। আমরা একসাথে কতবার ঘুরতে গিয়েছি। কিন্তু জানিস তাদের সাথে মেশার সময় আমি বুঝতেই পারিনি যে তারা কতো বড় মানুষ। কারন তারা বুঝতেই দেননি। আমার মনে হয় তারা নিজেরাও এসব নিয়ে ভাবতেন না। তারা তাদের সৃষ্টি সাধনায় এতটাই মগ্ন থাকতেন যে তাদের মধ্যে ‘আমি কি হনু’ এই ভাবনাটাই আসতো না। 

শা রা: এটা সত্যি, যে যতোটা সত্যিকারে মহান মহান হয়ে ওঠে তার আত্মঅহংকার ততটাই লোপ পায় 

শম্পা রেজা: লোপ পাবে কিরে, আমার মনে হয় তারা বুঝি জানতেনই না যে পৃথিবীর কোথাও আত্মঅহংকার বা জনপ্রিয়তা বলে কোন শব্দ আছে। এই যে তাদের এই আত্মঅহংকার না জানা এটাই তো সত্যিকারের চমৎকারিত্ব, এটাই শিল্পী আর শিল্পের সৌন্দর্য। আমার মনে হয় এইখানে আমাদের সবারই অনেক কিছু শেখার আছে। সঙ্গীত বলো আর যে কোন শিল্প বলো এটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযুক্ত একটা ব্যপার আর সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় একমাত্র বিনয়ের মাধ্যমে। তুমি বিনয় ছাড়া সৃষ্টি করতে পারবে না। বিশেষ করে সঙ্গীতে অহংকারের কোন জায়গা নেই। 

শা রা: আর আপনার অভিনয়ের ক্ষেত্রে কারা আপনাকে সমৃদ্ধ করেছে? 

শম্পা রেজা: দেখো আমি বললাম না যে অভিনয় নিয়ে আমি ভাবিনা। এটা কিন্তু সত্যি। আমি কখনোই চাইনি যে আমি অভিনয় করি। তবে অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি আগে স্ক্রিপ্টের চরিত্রটা দেখি। তারপর আমার বাস্তব জীবনে দেখা তেমন একটা চরিত্রের কথা কল্পনা করি, ওর বাহ্যিক রূপটা মনে করি, ওর পোশাক, ওর কথা বলা সব মনে করি আর বইয়ে পড়া চরিত্র তো আছেই। চরিত্রের অন্তর্গত অনুভূতি তুলে আনতে আমি বইয়ের আশ্রয় নেই। আর সেই অনুভূতির বাহ্যিকরূপ খুঁজে নেই আমার নিজের চেনা জগত থেকে। তারপর এই দুইটা বিষয়কে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারলেই আমার মনে হয় সুন্দর অভিনয়টা সম্ভব। 

শা রা: অভিনয়ের ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গীত কি আপনাকে সাহায্য করে 

শম্পা রেজা: অবশ্যই। কারন অভিনয়ের সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক সুগভীর। আমাকে অভিনয় করতে গেলে আমার ইমোশন লাগে, তাল লাগে, সুর লাগে, লয় লাগে এসবই তো সঙ্গীত থেকে নিতে হয়। মিউজিক ইজ মাস্ট ফর এক্টিং। যেকোন এক্টিং স্কুলে গেলে তুমি দেখতে পাবে সেখানে গান শেখা বাধ্যতামূলক।  

শা রা: সঙ্গীত আর অভিনয়ের অন্তর্গত সম্পর্কটা খুব চমৎকার ভাবে বলে দিলেন।

শম্পা রেজা: হ্যাঁ এটাই সত্যি। আমার বড় বোন রিনি, ও লন্ডন একাডেমী অফ মিউজিক অ্যান্ড ড্রামা থেকে পড়াশোনা করেছে। ওকে সেখানে অভিনয়ের সাথে সাথে গানও শিখতে হয়েছে। ও ছিলো বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ড পাওয়া অভিনেত্রী। তখন ও একটা সিনেমায় অভিনয় করেই তিনটা জাতীয় পুরষ্কার লাভ করে, তারপর ও অভিনয় ছেড়ে দেয়। ওর অভিনীত সিনেমা কবির আনোয়ার পরিচালিত সুপ্রভাত। সেটা ছিলো আমাদের দেশের প্রথম অফবিট সিনেমা বা আর্টফিল্ম। অবশ্য হিন্দু মুসলমানের বিয়ের দৃশ্য থাকায় সেই সিনেমা এদেশে কোথাও দেখানো হয়না।  

শা রা: তেমন একটা উজ্জ্বল সময়েই উনি অভিনয় ছেড়ে দিলেন?

শম্পা রেজা: হ্যাঁ। কারন আমাদের পরিবার খুব একাডেমিক ছিলো। তাই ও আবার পড়াশোনায় ফিরে গেলো। আমিও কিন্তু প্রথমে দুইটা নাটকে অভিনয়ের পর দীর্ঘ নয় বছর অভিনয় থেকে দূরে ছিলাম। বলতে পারো এটা আমাদের ট্র্যাডিশন... হাহাহা!

শা রা: আচ্ছা আমরা বারবার বলে এসেছি যে চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন মাধ্যমে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন চাই। আপনার কি মনে হয় সেই পরিবর্তন আসছে?

শম্পা রেজা: শোন তোমাকে একটা গোপন কথা বলি, আমি আসলে জীবনেও টিভি দেখিনা। টিভি দেখা মানে সময়ের অপচয়। তাই আমি বাংলাদেশের কাজের মান একজন দর্শক হিসেবে বলতে পারবো না।

শা রা: গোপন কথাটি রবেনা গোপনে

শম্পা রেজা: হাহাহা দুষ্ট, আচ্ছা যা ছেপে দিস। 

শা রা: আপনি যেই কাজগুলো করছেন সেই কাজ নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?

শম্পা রেজা: আসলে আমি কাজ করি আনন্দের জন্য। তাই আমি যেই চরিত্রের অফারগুলো গ্রহন করি সেগুলো আমাকে আনন্দ দেয় বলেই করি। আর সত্যি বলতে কি আজেবাজে চরিত্র নিয়ে আমার কাছে কেউ আসেনা। সেই হিসেবে আমার কাছে মনে হয় কাজ ভালো হচ্ছে। বর্তমানে আমার অভিনীত ডেইলি সোপগুলো তে আমার চরিত্রগুলো খুব মজার আর একটা চরিত্রের সাথে আরেকটা চরিত্রের মিল নেই। খুব মজার নাটক হচ্ছে এখন, মানুষকে আনন্দ দেবার মতো কাজ হচ্ছে।

শা রা: মানুষকে আনন্দ দেবার মতো কাজ হচ্ছে কিন্তু মানুষ কি সেই আনন্দটা গ্রহন করছে? 

শম্পা রেজা: দেখ এ বিষয়ে বলতেই হয়, তুই নিজেও একজন ডিরেক্টর। এখন তুই  যতো ভালোই নাটক বানাস লাভ নেই, কারন আমরা আগেই আমাদের দর্শক হারিয়ে ফেলেছি। আর দর্শক হারানোর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলের নির্বুদ্ধিতা, আমি সোজাভাবে এই ভাষাটাই ব্যাবহার করতে চাই যে চ্যানেলের নির্বুদ্ধিতার জন্যই আজকের দর্শকহীনতা। আজ পর্যন্ত আমাদের চ্যানেল মালিকরা বুঝতেই পারেনা যে তারা কিভাবে তাদের চ্যানেলের স্ক্রিনটা সাজাবে। এখন তো আর বিটিভির মতো একটা চ্যানেল না, এখন দেশে অনেক চ্যানেল তবে কেন সব চ্যানেলে একই ধরণের অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে? নিজস্ব একটা অনুষ্ঠানের ধারা তৈরি করে নিতে পারে। আমাদের প্রতিটি চ্যানেলেই একই সাথে সংবাদ, নাটক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সঙ্গীত অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, সিনেমা সব দেখাচ্ছে। আর আমাদের দেশে বিজ্ঞাপনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আমাদের দর্শক এখন ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। চ্যানেলগুলোকে আগে তাদের ফোকাস প্রোগ্রাম ঠিক করতে হবে আর বিজ্ঞাপনের লাগাম টানতে হবে।

শা রা: অনেক দিন যাবত অনেকেই বিজ্ঞাপন নীতিমালা নিয়ে কথা বলছে কিন্তু চ্যানেলগুলো কিন্তু চলছে তাদের মতোই 

শম্পা রেজা: আমি চ্যানেল মালিকদেরকে আগেও সরাসরি বলেছি যে দেখুন টেলিভিশনের উচিত মানুষকে একটু আনন্দ আর স্বস্তি দেয়া অথচ আপনারা চ্যানেলে কেউ একটা গান দেখছে এমন সময় নিয়ে স্ক্রলে দেখাচ্ছেন খুনের সংবাদ এতে করে দর্শক না পারছে গানের আনন্দ নিতে না পারছে খুনের পূর্ণাঙ্গ নিউজ দেখতে। আপনারা মানুষকে বিভ্রান্ত আর হতাশ করে তুলছেন। এটা ঠিক না। যেই মানুষটা সংবাদ দেখতে চায় সে সংবাদের চ্যানেলে যাবে, কিন্তু যেই মানুষটা আনন্দ পাবার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসছে তাকে কেনো আপনি খুনের সংবাদ দেখাবেন? ভারতীয় চ্যানেলগুলো কিন্তু দেখবে এটা করেনা। আমাদের এখনকার বাড়িতে সবচেয়ে বেশি কথা বলে টেলিভিশন। অতএব যাকে এতো কথা বলতে হয় তার কথা বলার ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়া জরুরী।

শা রা: টেলিভিশনের কথা বলা প্রসঙ্গে একটা বিষয় জানতে চাই। যেহেতু টেলিভিশন বেশি কথা বলে সেক্ষেত্রে তার ভাষার ব্যবহারটা কি আমাদেরকে প্রভাবিত করে?

শম্পা রেজা: গুড পয়েন্ট। ইয়েস অবশ্যই টেলিভিশনের কথা বলার আর্ট নিয়েও একটা নিয়ম থাকা জরুরী। কারন আমাদের দর্শকের উচ্চারণ নষ্ট করার পেছনে আমাদের টেলিভিশনও দায়ী। কারন টেলিভিশনে দর্শকদের পছন্দের অপশন নেই তাই টেলিভিশন যা দেবে দর্শক তাই দেখবে ও শিখবে। বিশেষ করে অশুদ্ধ উচ্চারণ বিকৃত উচ্চারণ আমাদের বাচ্চাদের মাথায় বসিয়ে দিচ্ছে টেলিভিশন। তুই অবাক হবি রাসএল যে আমার একটা স্কুল আছে সিলেটে। এই স্কুলটা আমি ২৬ বছর ধরে চালাচ্ছি। সেখানে টিচার্স নিয়োগ পরিক্ষা নিতে গেলে আমি পাগল হয়ে যাই এতো এতো শিক্ষিত মানুষ সেখানে জবের জন্য আসছে অথচ ওদের জিভ নষ্ট করে দেয়া হয়েছে, ওরা না জানে ইংরেজি না জানে বাংলা। এই নষ্ট জিভ পুনরায় ঠিক করার পেছনে অনেক দায়িত্ব আছে টেলিভিশনের। টেলিভিশনকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে।

শা রা: নতুন যারা মিডিয়ায় আসছে তাদেরকে কি উপদেশ দেবেন?

শম্পা রেজা: এখন তোরা যারা মিডিয়ায় নতুন হিসেবে কাজ করছিস তোরাই একদিন সিনিয়র হবি, তখন অনেক নতুনের জন্য তোদের মতো এখন যারা নতুন তারাই পথপ্রদর্শক হবে। তাই নিজেকে সেভাবে গড়ে তোল যাতে তোদের কাছ থেকে আগামী প্রজন্ম আলো পেতে পারে। 

শা রা: মিডিয়ায় নিজের অবস্থানে টিকে থাকার জন্য কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন?

শম্পা রেজা: এই টিকে থাকা শব্দটায় আমার আপত্তি আছে। টিকে থাকা শুনলেই মনে হয় একজন দুর্বল মানুষ কিছু একটা ধরে টিকে থাকতে চাচ্ছে। আমার মনে হয় চেষ্টাটা থাকা উচিত নিজেকে প্রস্তুত করায়, চেষ্টা থাকা দরকার নিজের কাজটাকে সুন্দর আর মানোত্তীর্ন করার। নতুনরা যদি নিজেকে শিল্প সাধনায় নিমজ্জিত করতে পারে তবে দেখবে ওদের জায়গা নিজে নিজেই তৈরি হয়ে যাবে। সেদিন একজন নবীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী আমাকে বলছিলো যে ‘আন্টি আমি দেখতে সুন্দর তাই আমার অভিনয় না জানলেও চলবে, আর আমি অভিনয় জানিও না’। আমি অবাক হয়েছিলাম। এইসব নবীনদের মাথায় এই কথাটা গেঁথে দেয়া হয়েছে যে তুমি সুন্দর হলেই অভিনেত্রী হতে পারবে। এই ভুল অহংকার থেকে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরী। কারন চেহারা দিয়ে গান, অভিনয়, নৃত্য কিছুই হয়না। মানুষ ২ মিনিট তোমার চেহারা দেখবে তারপর থেকে তোমাকে মানুষের কাছে থাকতে হবে তোমার অন্যান্য যোগ্যতা দিয়ে। 

শা রা: এই ধরণের ধারণাগুলো কি আমাদের প্রফেশনালিজমের অভাব থেকেই এসেছে? 

শম্পা রেজা: সেটা বলতে পারিস। কারন অন্যান্য দেশে অভিনয় শিল্পীদের এজেন্ট রয়েছে আর আমাদের দেশে এখন ফেসবুকে টুইটার আর ইনষ্টাগ্রামে সবাই নিজের প্রচার করছে। এভাবে নিজেকে প্রচার করাকে বা নিজেকে সেলিব্রেটি বানিয়ে তোলার যে প্রচেষ্টা এটাকে প্রফেশনালিজম বলে না। এজেন্ট সিস্টেম আমাদের এখানেও আসবে। তখন আর্টিষ্টদের মধ্যেও প্রফেশনালিজম আসবে। 

শা রা: আপনাদের সময়ের কালচারাল পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশের মধ্যে তফাৎ কি? 

শম্পা রেজা: অনেক অনেক তফাৎ। সময় পাল্টে গেছে, সময়ের ধর্মই পাল্টে যাওয়া। আর এই পাল্টে যাওয়াটা গ্রহন করতে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

শা রা: এই পাল্টে যাওয়াটা কি ইতিবাচক হয়েছে? তবে আমরা নতুনদের ভেতর হুমায়ূন ফরিদি, সুবর্ণা মোস্তফা, মিতা চৌধুরী, শম্পা রেজা এদেরকে কেন পাচ্ছিনা? 

শম্পা রেজা: দেখ তুই যাদের কথা বলছিস আমরা সবাই কিন্তু সদ্যজন্ম নেয়া বাংলাদেশে কালচারাল ওয়ার্ল্ডে কাজ শুরু করি। তখন আমার বয়স খুব কম ছিলো। কিন্তু মিতা, সুবর্ণা, নূর ভাই আমরা কিন্তু একটা অন্য স্পিরিট নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের তখন মাথায় থাকতো এখন আমরা স্বাধীন। পাকিস্তান আর তাদের কালচার আমাদেরকে চাপিয়ে দিতে পারবে না, আমরা নিজেরা নিজেদের কালচারাল ওয়ার্ল্ড নির্মাণ করবো। আমাদের গান, নাটক, থিয়েটার, নৃত্য, সিনেমা সবকিছুকে আমরা আমাদের নিজস্বতা দিয়ে তৈরি করবো। এইযে আমাদের নিজেদের কালচারাল ওয়ার্ল্ড নির্মানের ভাবনা বা স্পিরিট ছিলো এটাই বোধহয় আমাদেরকে ভালো কাজে উৎসাহিত করেছিলো। আমাদের এখনকার কালচারাল অ্যাক্টিভিষ্টরা যদি সেভাবে নিজেদের নিজস্বতা তৈরির কথা ভাবে তবে সত্যি আমাদের সামগ্রিক অবস্থাটা কাঙ্ক্ষিত রূপ পাবে। আমরা এখন নিজস্বতা হারাচ্ছি। আমি যখন শান্তি নিকেতনে থাকতাম তখন দেখেছি যে আমাদের দেশের টেলিভিশন নাটক দেখার জন্য কলকাতার মানুষ তাদের টেলিভিশনে উঁচু করে অ্যান্টেনা লাগাতো। কিন্তু এখন দৃশ্য পাল্টে গেছে আমাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য।

শা রা: অভিনেত্রী শম্পা রেজার আত্মতৃপ্তি কিসে? 

শম্পা রেজা: দেখ আমি সত্যি এখন অভিনয় করি জীবনটাকে আনন্দময় করতে। আনন্দ করতে। ছোটবেলায় আমি কোন সিনেমার অফার গ্রহন করিনি কারন গান ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবতেও পারিনি। তখন গানের মেয়ে চরিত্রের লোভ দেখিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন ভাই আর আতিকুর রহমান ভাই আমাকে দিয়ে দুইটা নাটকে অভিনয় করিয়ে নিলেন। এরপরই আমি শান্তি নিকেতনে চলে যাই। তারপর টানা নয় বছর আমি অভিনয় থেকে দূরে থাকলাম। কিন্তু বাংলাদেশে এসে দেখলাম আমার ক্লাসিক গান এদেশের মানুষের সাথে রিলেট করতে পারছিনা। কিন্তু আমি বিলিভ করি নিজস্ব রোজগারে। খুব অল্প বয়স থেকে আমি নিজের পকেট মানি নিজেই উপার্জন করতাম। তাই একটু টেনশনে পড়ে গেলাম যে এখানে আমি কি করবো? এরপরে মূলত পকেট মানির জন্যই আবার অভিনয় শুরু করি। আমি আনন্দের জন্য বাঁচি আর সেই আনন্দ খোঁজার পথ হচ্ছে আমার গান আমার অভিনয় আমার চিত্রকর্ম।

বাইরে বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ। এবার ফেরার পালা। শম্পা রেজা আর তার প্রিয় কুকুর রোদ আমাকে এগিয়ে দিলো লিফট পর্যন্ত। এবার ফিরতি পথে আমার গাড়ি ছুটছে আর আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে শম্পা রেজার আনন্দ খোঁজার সুদীর্ঘ যাত্রার গল্প। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত