সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলনে গ্রন্থাগারের প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০১৭, ১৭:১১

কনক মনিরুল ইসলাম

বাঙালির জীবনভরা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার রূপসন্ধানের প্রচেষ্ঠায় বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সেদিন বীর বাঙালি হাজারো বছরের লালিত সৃষ্টিশীলতার তুঙ্গীয় নিদর্শণ ও বহুমাত্রিক প্রতিভার সুদীপ্ত উপস্থিতিতে সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে আমাদের মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকার। বপণ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজ।

মাতৃভাষা হলো মানুষের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। তাই মানব জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন দার্শনিক, মনীষী, কবি-লেখক-শিল্পী মাতৃভাষার গুরুত্বকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। মাতৃভাষা হলো মন, মনন ও চিন্তনের ভাষা। মানুষের আনন্দ, বেদনা, সুখ-দুঃখ মাতৃভাষার মাধ্যমেই যথার্থভাবে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি জীবনের ইচ্ছা আকাঙ্খা, সমাজ জীবনের শিক্ষা- সংগ্রাম-আন্দোলন সংস্কার জাতীয় জীবনের ঐক্য শৃঙ্খলা পরিকল্পনা ও কর্মতৎপরতা তথা নাগরিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মাতৃভাষা পালন করে অনন্যসাধারণ ভূমিকা।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন চরাই উৎরাই পেরিয়ে এ ভাষা ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। এ ভাষায় রচিত হয়েছে মূল্যবান সাহিত্য কর্ম। কিন্তু নানা সময়ে বাংলা ভাষার উপর বহুবিধ আক্রমণ ও আঘাত  এসেছে, বাংলা ভাষার বিকাশকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র চলেছে। ব্রিটিশ আমলে এ ভাষা পেয়েছে চরম অবহেলা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৫২ সালে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর হাতে ও ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলার দামাল তরুণদের।

জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার অবাধ ব্যবহার ছিল তরুণদের প্রধান দাবী। তৎকালীন দুই পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্টীর ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার বিকাশকে রুদ্ধ করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছে। এর ফলেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন এবং মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য ছাত্র জনতার আত্মদানের বিরল দৃষ্টান্ত।

পৃথিবীতে বাঙালিরাই সেই গৌরবময় জাতি, যারা মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য জীবন দিয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। কারণ ১৯৯৯ সনের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো আমাদের ভাষা শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং বাংলা ভাষার সম্মানে ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও বাংলা ভাষা আজও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহৃত হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ একটি ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্র। বাংলা ভাষা দেশের সমগ্র জগগোষ্ঠীকে একই বন্ধনে বেঁধে রাখছে। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের সৃষ্টি সম্ভারে বাংলাভাষা আর বাংলা সাহিত্য আজ ঐশ্বর্যমন্ডিত। এভাষা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। ধনিতাত্ত্বিক দিক থেকেও এ ভাষার কোনো দৈন্য নেই। এ জন্যই বাংলা ভাষা জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারযোগ্য এবং প্রয়োগ তেমন কোন সমস্যা নেই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে।

বাংলা পরিভাষায় জটিলতা এবং মানসম্মত অনুবাদ শব্দ ব্যবহারের অদক্ষতা রয়েছে। এখনো বিচার বিভাগের বিভিন্ন আইন ও রায় সমূহ ইংরেজিতে লেখা হয় ফলে ইংরেজি শব্দাবলীর অনুবাদে অসুবিধা হয়। বিভিন্ন চিকিৎসা বই সমূহ এবং বৈজ্ঞানিক বই সমূহের শব্দগুলোর বাংলা অর্থ করা কষ্টসাধ্য বিধায় এখনও সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়নি। এছাড়া ইংরেজী থেকে বাংলার উত্তরণের মানস্তাত্ত্বিক জড়তাও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অন্যতম অন্তরায়। এসব সমস্যা উত্তরণে বিভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। বাংলা একাডেমী থেকে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা পরিভাষা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এগুলো অপ্রতুল।

তাছাড়া কিছু সংখ্যক ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার উপযোগী নয়। আবার অনেক পরিভাষার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কেও প্রচুর সন্দেহ রয়েছে। বাংলায় যথাযথ অনুবাদের জন্য মান সম্পন্ন শব্দাবলীর প্রয়োজন। আর প্রয়োজন দেশের প্রধান প্রধান পন্ডিতও গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের সমন্বয়ে ভাষার একটি ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত বিধান এবং এর প্রয়োগ ও ব্যবহারে দেশের সর্বশ্রেণীর ও পেশার মানুষের আন্তরিকতা। শিক্ষা ক্ষেত্রে পান্ডিত্যপূর্ণ পরিভাষা ব্যবহার করলেও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক পরিভাষা প্রয়োজন সমাধিক। বাংলাদেশে এখনো উচ্চ শিক্ষার ভাষা, উচ্চ আদালতের ভাষা ইংরেজি। কিন্তু এটা হবার কথা ছিলো না। কথা ছিলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে। কিন্তু হয় নি। সর্বস্তরে বাংলা চালু না হবার পেছনে সরকারের উদ্যোগের অভাব এবং জনগণের অনীহাই মূল কারণ। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য সরকারকে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে গ্রন্থাগার ও তথ্য কেন্দ্র সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞান, মানব বিজ্ঞান এবং আইন সংক্রান্ত উচ্চতর শিক্ষা গ্রন্থসমূহ ব্যাপকভাবে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ না করার জন্য উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজির প্রধান্য অক্ষুন্ন রয়েছে। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং আইন ও প্রশাসনিক বিধি বিধানের ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার সমূহ প্রকৌশল, চিকিৎসা ও আইনের গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক সমূহ চিহ্নিত করে আধুনিক ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রন্থাগারের ন্যায় পুস্তকসমূহ অনুবাদের ব্যবস্থা করতে পারে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর গ্রন্থাগারে অনুবাদ বিভাগ রয়েছে যা গুরুত্বপূর্ণ ও পাঠকপ্রিয় প্রকাশনা গুলো অনুবাদ করে থাকে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন  শুরু করতে হলে গ্রন্থাগার সমূহের অনুবাদ সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। 

অফিস আদালতে, উচ্চতর শিক্ষা ও বিশেষ পরীক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের সবচেয়ে বেশী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলায় উত্তরণের মনস্তাত্বিক জটিলতা। আমাদের ঔপনিবেশিক আমলের চিন্তা-পরিপুস্ট মানসিকতা চিরকালই স্বদেশের শিক্ষা সংস্কৃতি ভাষা থেকে বিদেশের ভাষা সংস্কৃতিকে বড় করে দেখেছে। তাছাড়া শ্রেণি বৈষম্য টিকিয়ে রাখার জন্য সুবিধাবাদী শিক্ষিত শ্রেণি আজও ইংরেজি ভাষার পক্ষে দূর্বলতা পোষণ করছেন। এই ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার সমূহ বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে সেমিনার ও পুস্তক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে। তাছাড়া শিক্ষক,আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য বিশেষ গ্রন্থাগার সেবা প্রদান করতে পারে। সাথে সাথে জ্ঞানরাজ্যে থেকে বাংলা বিভিন্ন বই সংগ্রহ করে পাঠক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে বিতরণ করতে পারে। ফলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সহজতর হবে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রয়েছে। এই জন্য সরকারকে নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা যায়। আর এই কমিটি গঠিত হলে গঠিত কমিটিকে তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে গ্রন্থাগারসমূহ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বাস্তবায়ন কাজ আরম্ভ হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে আসবে গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার পেশজীবীদের। কারণ ইংরেজি থেকে নানাবিধ আইন ও প্রকাশনা অনুবাদের জন্য প্রয়োজন হবে নানা ধরনের সহায়ক পুস্তক ও প্রকাশনার। এক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের ভূমিকা হবে সর্বাগ্রে।

লেখক: সরকারি কর্মকর্তা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত