ভেস্তে গেছে অতিরিক্ত ১ লাখ ৯১ হাজার টন ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১২

জাগরণীয়া ডেস্ক

আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন (আইআরডি) প্রকল্পের সেচ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রকল্পটি নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে কাজে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। ১৯৯২ সালে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর পর বিগত ২৫ বছরেও প্রায় ১৭ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষকরা কাঙ্খিত সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, প্রকল্প এলাকায় ১৮ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে বছরে অতিরিক্ত এক লাখ ৯১ হাজার টন ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।

প্রকল্প এলাকার কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, দেশে গত ১ ডিসেম্বর থেকে বোরো মৌসুমে শুরু হয়েছে। পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কমান্ড এরিয়া বেড়া-সাঁথিয়া উপজেলায় গত মওসুমে বোরোর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল দুই হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছিল ৮০০ হেক্টরে। চলতি মওসুমে আজ পর্যন্ত বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। প্রতি বছরই প্রকল্পের সেচ এলাকায় জমির পরিমান কমছে। প্রকল্পের সেচ ক্যানেলের ক্ষতিগ্রস্ত ডাইক বাঁধ সংস্কার বা মেরামত করা হয়নি। ফলে প্রকল্প থেকে পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে কি-না, তা নিয়ে কৃষকদের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

বেড়া পাউবো সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সালে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ১৯৯২ সালে শেষ হয়। প্রকল্পের আওতাভুক্ত এক ফসলী জমি তিন ফসলীতে রূপান্তর এবং ১৮ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে বছরে অতিরিক্ত এক লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিগত ২৫ বছরে এই লক্ষ্যমাত্রার সিকি ভাগও অর্জিত হয়নি। কারন প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ায় প্রায় ১৭ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমি আজ পর্যন্ত সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে কমান্ড এরিয়ার কৃষকরা নিজ উদ্যোগে সেচযন্ত্র স্থাপন করে জমিতে ফসল উৎপাদন উদ্যোগ নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের সেচ সুবিধা প্রদানের জন্য সাড়ে ৪২ কিঃ মিঃ প্রধান সেচ ক্যানেল (পানি সঞ্চয়াগার), ১৯টি সেকেন্ডারী ক্যানেল, ৪৭টি টারশিয়ারী ও চার শতাধিক মাইনর ক্যানেল নির্মাণ করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। চালুর ২৫ বছরে প্রকল্পটির সেচ ও ফসল উপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অথচ ১৯৯২ সাল থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত সেচ ক্যানেলের ডাইক বাঁধ মজমুতকরণ, সম্প্রসারন, সেচ ক্যানেল সংস্কার বাবদ এডিবি এবং জিওবি খাত থেকে প্রায় সাড়ে ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অথচ প্রকল্পটির একটি সেকেন্ডারি, ৩০টি টারসিয়ারি ও ২০০ শতাধিক মাইনর ক্যানেলে আজ পর্যন্ত পানির প্রবাহ ঘটানো সম্ভাব হয়নি। সচল ক্যানেলগুলো যথাযথভাবে সংস্কার না করায় অকার্যকর হয়ে পড়ছে। হাটুরিয়া, জগন্নাথপুর, পেঁচাকোলা, বায়া, পানশাইলসহ অনেক এলাকায় সেচ ক্যানেল মাটির সাথে মিশে গেছে। অনেকে ক্যানেল ভরাট করে দোকানঘর তুলেছে। এ ব্যাপারে বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। প্রকল্পের সেচ ক্যানেলগুলো দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়ায় কৃষকরা সেচ সুবিধা পাচ্ছে না। অথচ প্রকল্পের ক্যানেল সংস্কারের জন্য প্রতি বছর প্রায় এক কোটি টাকা থোক বরাদ্দ হয়।

প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল একজন প্রকৌশলী জানান, ১৯৯২ সালে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। ওই বছর দুই হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘোষণা দেয়, প্রজেক্টের সেচ ক্যানেল ক্রটির কারণে সেচের কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের অবকাঠামো ক্রটিমুক্ত করতে শুধুমাত্র ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২  পর্যন্ত এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ১৫০ কোটি টাকাসহ মোট ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বরাদ্দ অর্থের প্রায় ৭০ ভাগই লোক দেখানো নামমাত্র কাজ করে আত্মাসাত করা হয়েছে। এর ফলে গত ২৫ বছরে প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ায় সেচ লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার ৬৮০ হেক্টর তো দুরের কথা সিকি ভাগ জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় সেচের জমি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮০০ হেক্টরে।

পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কমান্ড এরিয়াভূক্ত বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ, হরিরামপুর, কৈটোলা, নতুন পেঁচাকোল, মাছখালি, সাঁথিয়া উপজেলার গাগড়াখালী, ছেচানিয়া, সানিলা, বড়গ্রাম, বোয়াইলমাড়িসহ ৪০টি গ্রাম সরেজমিন ঘুরে ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২৫ বছর ধরে তারা প্রকল্পের সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। ওই গ্রামগুলোর কৃষকদের মাঠে নিজ নিজ উদ্যোগে সেচযন্ত্র স্থাপন করে বোরো চাষের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। এতে প্রতি বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেশি খরচ হবে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।

পানি ব্যবহারকারী সমিতির সভাপতি আনছার আলী জানান, প্রকল্পের সেচ সুবিধাভোগী চাষিদের তিনটি ফসল আবাদের জন্য বিঘা প্রতি বছরে মাত্র ১৮০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। এতে প্রকল্পের সেচ সুবিধা প্রাপ্ত কৃষকদের ফসল উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়ছে। অপরদিকে প্রকল্পের সেচ সুবিধা বঞ্চিত কৃষকদের নিজ উদ্যোগে সেচযন্ত্র স্থাপন করে জমিতে সেচ দিতে হয়। এতে শুধুমাত্র বোরো ধান উৎপাদনের জন্য কৃষকদের সেচ বাবদ চার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। প্রকল্পভূক্ত ১৭ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসেনি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, চলতি মওসুমে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধরণ করতে পারেনি। তারা গাজনার বিল বহুমুখী এবং পদ্মা ও যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার কাজ নিয়ে তৎপর রয়েছেন। কিন্তু অধিক ফসল উৎপাদনে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাদের কোন মাথা ব্যাথাই নেই।

এ ব্যাপারে বেড়া পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হামিদ জানান, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এই ইরিগেশন প্রজেক্টটি পুরোদমে চালু করার জন্য পরিকল্পিতভাবে সেচ ও নিস্কাশন ক্যানেলসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ও সংস্কার সাধন করতে হবে। তবেই পাবনা সেচ প্রকল্পে ফসল উৎপাদনের কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এছাড়া কৃষক পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, শাক-সবজিসহ অন্যান্য লাভজনক ফসল আবাদে ঝুঁকে পড়ায় বোরো আবাদের জমির পরিমান প্রতি বছরই কমছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত