ছোটগল্প

সৌরভ কাঁদছে, মিলি কাঁদছে!

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ০২:৩২

সাদাত হোসাইন

কথাটা সিরিয়াস মিলি। আমি অনেকদিন দিন থেকেই ভাবছি, এভাবে আর চলতে পারে না। কথাটা আমার তোমাকে জানিয়ে দেয়া দরকার। এই নিয়ে তোমার সাথে অনেক সমস্যা হয়েছে। আর না। আমি চাই না, এটা এমন চলতেই থাকুক। এইজন্যই বিষয়টি আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই। অনেকতো হলো!'

সৌরভের কন্ঠ ভারি। মিলি ফোনের ওপারে কাঁপছে। সে যা আশংকা করছিল ঘটনা তাহলে তা-ই। তাদের বিয়ের কথা ছিল এই ডিসেম্বরে। কিন্তু জুলাইয়ে নতুন জব পাওয়ার পর থেকেই সৌরভ কেমন বদলে যেতে থাকল। সারাদিন অফিস। ফোন করলে ফোন ধরার সময় পায় না। গভীর রাতে বাসায় ফিরে এক মিনিটের জন্য ফোন দিয়ে বলে, 'খুব টায়ার্ড, এখন রাখছি। ঘুমাবো। বাই'।

মিলিকে কিছু বলার সুযোগও দেয় না। দুম করে ফোন রেখে দেয়। মিলির বাকীটা রাত কাটে নির্ঘুম। ছটফট করে। সৌরভকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। চার বছরের সম্পর্কে সৌরভের প্রতি তার ভালোবাসা মুগ্ধতা এতটুকু কমেনি। কিন্তু নতুন চাকুরী পাওয়ার পর থেকেই সৌরভ কেমন বদলে যাচ্ছে। বার কয়েক ঝগড়াও হয়েছে। মিলি অসংখ্যবার অভিযোগ করেছে। কিন্তু সৌরভ সেসব পাত্তা দেয় নি। এইসব অভিযোগ, অনুযোগ শোনার সময় কই তার?

মিলি কেঁদেছেও। সৌরভের সাথে দেখাও হয় না কত দিন! তার সময় হয় না। মিলি ঠিক ঠিক টের পাচ্ছে, সামথিং ইজ রং, ভেরি ভেরি রং। কিন্তু কি করবে সে? বিয়েটা ভেঙে দেবে? কিন্তু সৌরভকে ছাড়া সে কি করে থাকবে? নাহ, সে সৌরভকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কক্ষনো না। কিন্তু সৌরভ?সৌরভের আজকের কন্ঠস্বর মিলি এর আগে কখনো শোনেনি। গম্ভীর। কাঠকাঠ। তীক্ষ্ণ।যেন সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলেছে। এখন কেবল জানিয়ে দেয়ার পালা। মিলির গলা শুকিয়ে আসছে। বুক কাঁপছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মিলি কোন কথা বলল না।
সৌরভ বলল, 'আমি জানি , হয়তো এভাবে বলছি, বিষয়টা তুমি নিতে পারবে না। কিন্তু আসলে আমার আর কিছুই করার নেই। এভাবে লুকোচুরি করার চেয়ে বিষয়টি তোমাকে স্পষ্ট করেই বলে ফেলা উচিৎ'।
মিলি কথা বলছে না। নিশ্চুপ।

সৌরভ যেন খানিক গলা চড়াল, 'কথা বলছ না কেন তুমি? কেউ কথার জবাব না দিলে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়'।

মিলি তাও কথা বলল না। সে কাঁদছে। ভাগ্যিস কথা হচ্ছে ফোনে, সৌরভ দেখতে পাচ্ছে না। সৌরভ তাকে ছেড়ে চলে যাছে, এই কান্না লজ্জার, অপমানের, পরাজয়ের, সে তার এই লজ্জার কান্না সৌরভকে দেখাতে চায় না।
সৌরভ বলল, 'বিষয়টা নতুন চাকুরীতে ঢোকার পর থেকেই আমি টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু নানা কারণেই তোমাকে বলতে পারছিলাম না।একটা সংকোচ, অপরাধবোধ কাজ করছিল। কিন্তু এখন আর না বলে পারছি না।'
মিলি চুপ। সে কাঁদছে।

সৌরভ বলল, 'সমস্যা বসের মেয়েটা। অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে। অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট। সে-ই এখন আমার রিপোরটিং বস।'
মিলির কান্না হঠাৎ থেমে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কাঁদবে না। সৌরভ অন্য কারো কাছে গেলে যাক।সে কাঁদবে না।
সৌরভ বলল, 'আমি জানি, আমার কথাটা তুমি নিতে পারবে না। কথা শেষ হবার পর তুমি কাঁদবে। কিন্তু মিলি, জীবনে কিছু কিছু সত্যি আছে যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মেনে নিতেই হয়। আর আমাদের কাছে পরিস্থিতিটাও গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র চারমাসের চাকুরিতে প্রোমোশন হয় না। কিন্তু আমার সামনে একটা বড় সুযোগ ছিল। মেয়েটা বলেছিল, চারমাসের যদি আমি তাকে হ্যাপি করতে পারি, আমার প্রোমোশন হয়ে যাবে'।
মিলি কাঁদছে না। সৌরভের এই রূপটা তার জানা ছিল না। এত নোংরা একটা মানুষকে সে ভালবেসেছিল!
সৌরভ বলল, 'আজ একটা বিশেষ দিন। এইজন্যই সিদ্ধান্তটি তোমাকে জানিয়ে দেয়া উচিৎ। দয়া করে সিদ্ধান্ত শোনার পর ফ্যাচফ্যাচ করে তুমি কাঁদবে না। আমার কান্না অসহ্য লাগে'।
মিলি কাঁদছেও না। তার কেমন অবশ অবশ লাগছে।

সৌরভ বলল, 'আজ আমার প্রমোশন কনফার্ম হয়েছে। এইজন্যই তোমাকে আজ ফাইনাল ডিসিশনটা জানিয়ে দেয়া উচিৎ'।
মিলি চুপ।
সৌরভ বলল, 'আমার বেতন কত হয়েছে জানো?
মিলি চুপ।
সৌরভ বলল, 'তুমি চিন্তাও করতে পারবে না'।
মিলি চুপ।
সৌরভ বলল, 'এবার ডিসিশনটা শোন। তোমার ফ্যামিলিকে তুমি কিভাবে জানাবে, আমি জানি না। বাট তোমাকে ম্যানেজ করে নিতে হবে'।
মিলি চুপ।
সৌরভ বলল, 'সরি মিলি, ডিসেম্বরে আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না'।
মিলি ভাবছিল সে কাঁদবে না। সে এই কথা জানত। সৌরভ যে এটি বলবে সেটি স্পষ্টই ছিল। কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু সে কাঁদল না। সে সৌরভের কাছে তার কান্নার শব্দ পৌঁছাতে চায় না।
সৌরভ বলল, 'আমাদের বিয়েটা ডিসেম্বরে হচ্ছে না। জানি তোমার অনেক খারাপ লাগছে। অনেক প্রস্তুতি ছিল। রিলেটিভস বন্ধু বান্ধবরা সবাই জানত। আমি সবই জানি। কিন্তু আর কোন উপায় নেই মিলি। তুমি আমাকে মাফ করে দিও'।
মিলি এই প্রথম কথা বলল, তার গলা কাঁপছে, সে বলল, 'আমাকে কি স্পষ্ট করে বলবে, কারনটা কি?'
সৌরভ খানিক চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, 'হু, বলব'।
মিলি এবার যেন খানিক শক্ত হল, সে বলল, 'হ্যাঁ, বল'।
সৌরভ বলল, 'কারণ আমাদের বিয়েটা হবে কাল ভোরে।'
মিলি একটা ধাক্কার মত খেল। সে সৌরভের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। কি বলছে সৌরভ? কার বিয়ের কথা বলছে?
সৌরভ বলল, 'তুমি বাসায় কিভাবে ম্যানেজ করবে আমি জানি না। কাল ভোরে আমরা বিয়ে করব। অফিস আমাকে একটা টার্গেট দিয়েছিল। আমি যদি চারমাসে সেটা ফুলফিল করতে পারি, বলেছিল তারা আমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। আমি লাস্ট চারমাসে অমানুষের মত খেটেছি। কারো সাথে কথা বলি নি। আব্বু আম্মুর সাথেও না। শুক্র-শনি, দিন-রাত কাজ করেছি। অমানবিক পরিশ্রম করেছি, অমানবিক। সিমপ্লি ইনহিউম্যান। অ্যান্ড টুডে আই গট দ্যা সারপ্রাইজ। আমার বেতন দ্বিগুনের বেশি হয়ে গেছে। তারচেয়েও বড় কথা আর চারদিন পরেই অফিস আমাকে একটা পনের দিনের ট্যুরে সুইজারল্যান্ড পাঠাচ্ছে। তবে আমার বসের সেই সুন্দরী মেয়েটা বলেছে, আমি চাইলে আমার বউ-কেও সাথে নিয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে অফিসের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আরও পনেরদিন আমি সুইজারল্যান্ডে থেকে যেতে পারি। খরচটা অফিসই দেবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমারতো বউ নাই। এখন কি কর বলতো? তুমি কি কাল আমার বউ হবে? প্লিজ? আমি জানি, তোমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তোমার বিয়ের এতো এতো আয়োজন, এতো এতো প্ল্যান, সব আমি ভেস্তে দিয়ে দিলাম। কিন্তু কি করব বল? তোমাকে ছেড়ে যে ওই অতদুর আমি একা একা থাকতে পারব না। পারবই না। একদম না। প্লিজ। প্লিজ বি মাই বউ বাই টুমরো। প্লিজ, প্লিজ...'
মিলি কথা বলছে না। সে হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। হাউমাউ করে। এই কান্নার শব্দ সে আটকাতে পারছে না। অবশ্য সে আটকাতে চাইছেও না। সে কাঁদছে। কাঁদছেই। সৌরভ হাসছে। তার খুব ইচ্ছে করছে মিলিকে বুকের সাথে চেপে ধরে হা হা হা করে হাসতে। কিন্তু সে হাসতে পারছে না। সে মুগ্ধ হয়ে মিলির কান্না শুনছে। জগতে কান্নারাও এতো সুন্দর হতে পারে! এতো শ্রুতিময় হতে পারে! তা সৌরভের আর আগে কখনো জানা ছিল না। সে জগতের সকল মুগ্ধতা নিয়ে মিলির কান্না শুনছে। সে হঠাৎ আবিস্কার করল, তার গাল গড়িয়েও কি যেন নেমে আসছে! আরিহ, জল নাকি? ধুর, জলইতো! কী আশ্চর্য! সে কাঁদছে কেন?
সৌরভ কাঁদছে, মিলি কাঁদছে!
কাঁদছে জগতের শ্রেষ্ঠতম আনন্দের শুদ্ধতম কান্না।

সাদাত হোসাইন’র ফেসবুক থেকে
 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত