ছোটগল্প

ভাসমান

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০১৭, ২১:৩০

সন্ধ্যাবেলা পুকুরের কালো হয়ে আসা পানির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে রহম আলী। কিছুদিন আগেও একে পুকুর ঠিক বলা যেত না, ওটা ছিল প্রায় মজে যাওয়া ডোবা মতন। ওরাই কেটেকুটে একে পুকুরের মর্যাদা দিয়েছে। খাওয়ার পানি, নাওয়ার পানি, গৃহস্থলির কাজ সব এখানেই সারে ওরা। রহমের ছোট ছেলেটা ওখানে কোথা থেকে এনে কয়েকটা তেলাপিয়া মাছের পোনাও ছেড়েছে। সেই পুকুরের দিকে তাকিয়েই এই ভর সন্ধ্যায় একা একা বসে আছে সে। মাঝে মাঝে যেন একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। 
-মানুষটা কি কাঁনতিছে নাকি ওখানে বসে? হলো কি তার ! বাপ-মা তো মরে গেছে সেই কোন ছোট কালে তাহলে এখন কার দুঃখে সে! অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে জমিলার। দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে যায় স্বামীর দিকে। 

সন্ধ্যাবেলা এখানে একা একা বইসে রইছেন কেন? নামাজ পড়তিও গেলেন না।
সর্বহারার দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকায় রহম আলী।
তার ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে জমিলা বলে কি, কি হইছে আপনার? এমন করতিছেন কেন? জমিলার কপাল জুড়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
- এ জমিও ছাড়তি হবে বৌ! 
- কন কি? আঁতকে ওঠে জমিলা। 
- হ্যরে বৌ, জমির মালিক নাকি বারেকের কাছে খবর পাঠায়েছে এখানে বরফ মিল বানাবে। 
- বরফ মিল! এইখানে বরফ মিল হবে?
- বারেক তো কইলো হবে। 
- কিন্তু এখানে তো কোনো মাছের চাষ হয় না, নেই কোনো মাছের আড়ত খানা। 
রহম আলীর বৌ জমিলা যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। তার বাপের বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলের কয়রা। সে জানে যে সব অঞ্চলে মাছের চাষ হয় সেখানেই সাধারণত বরফ মিলগুলো করে মিল মালিকেরা। কিন্তু এখানে এই মূলগাঁওয়ে নেই কোন মাছের ঘের, নেই কোন সী ফুড কোম্পানি। এখানে মানুষের প্রধান জীবিকাই হলো কৃষিকাজ। সেখানে বরফ কল কেন হবে কিছুতেই বুঝতে পারেনা সে। 
- বরফ বানাবে কি গলায়ে ফেলতি? গলায় ঝাঁঝ জমিলার। 
- তা তো জানি না বৌ। 
- জানেন না- তা জিজ্ঞেস ও করতি পাইরলেন না? 
- আমি কি জিজ্ঞেস করব- বড়লোকের কারবার। 
- এসব ছল, বুইঝলেন সব ছল। 
দেড়বিঘা জমির ওপর করা কৃষি ক্ষেতের ওপর চোখ বুলায় জমিলা। কষ্টে তার চোখ লোনা জলে ঝাপসা হয়ে আসে। কত কষ্ট করে সে আর তার স্বামী ঝোপ জঙ্গল কেটে পতিত এ জমিতে ফসল ফলিয়েছে। কোদাল দিয়ে মাটিতে কোপ বসালেই উটে আসতো বড় বড় গাছের মুড়ো। সেই মুড়ো কেটে পতিত জমিতে সোনা ফলাতে যে কত কষ্ট সে জমিলা ছাড়া আর কে বুঝবে! 

এই জমির মালিক থাকে বিদেশে। তার আরো জায়গা জমি আছে এখানে। সেই সব জমি-জমার দেখাশোনা করে বারেক। এই জমির দেখভালও বারেকই করত। এই জমিতে যখন রহমকে প্রথম এনে তোলে বারেক, তখন এই জমি ছিল একেবারেই পতিত। বন-জঙ্গলে খানা-খন্দে সাপ-কোপে ভরা জায়গা। রহমেরও কোনো উপায় ছিল না। সে যে কোনো রকমে মাথা গোজার একটা ঠাঁই পেয়েছে তাই ছিল তার জন্য যথেষ্ট। 

বারেক মালিকের ধানি জমি, কৃষি জমি সব কিছু চাষবাস করে দেখভাল করে আজ বেশ স্বচ্ছল। তার ঘরে দুজন মহিলা কাজ করে, জমিতে সার্বক্ষণিক কাজ করে চারজন পুরুষ। 
রহমেরও এবার ফসল ভালই উঠেছে। একবিঘা জমিতে চৈত্র মাসে উঠেছে গম। খানিকটা উচু জমি তাই সে গমের চাষ করেছিল। প্রথম বছর তো জমি ঠিক করতেই অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, তারপরও লাউ বিক্রি করেছিল ২২ হাজার টাকার। অন্যান্য শশা, লাল শাক, কুমড়ো, আলু- মুলাও কিছু ফলেছিল। এনজিও থেকে কৃষি করতে ১৪ হাজার টাকা লোন এনেছিল শোধ বোধ দিয়ে সে তার কুড়ে ঘর ভেঙ্গে বড় করেছে। টিন লাগিয়েছে ঘরের চালে। এ বছর ভেবেছিল কৃষি করে যা হয় সেই পয়সা দিয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য একখানা সোনার গয়না গড়িয়ে রাখবে। মেয়েটা দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেল। এ বছর ১৬য় পা দেবে। চেহারা সুরত দেখলে কেউ বলতে পারবে না গরীব ঘরের মেয়ে। রহমের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বাকী দুজন ছোট। তাদেরকে মূলগাঁও প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। ছোট মেয়েটা কাস ফোরে আর ছেলেটা টুতে পড়ে। বড় মেয়েটার লেখা পড়া হলো না বলে রহমের দুঃখ হয় মাঝে মাঝে। কি করে হবে! রহমের যে পোড়া কপাল! তার পৈত্রিক বাড়ী ছিল পদ্মার পাড়ে। 

বিশাল পদ্মার আরো বিশাল জলরাশি দানবের মতো আঘাত হানল কুলে। এই ভাঙ্গনের নেশা যেন পেয়ে বসল পদ্মাকে। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে কুলে। আর পাড় ভেঙ্গে বিলীন হয় অথৈ জলে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদিন বিলীন হয়ে গেল রহমের ধানি জমি, বাপ দাদার ভিটে স-ব। নদী ভাঙ্গা মানুষ কুল কুল করে ছোটে শহরের দিকে। রহমও তখন জীবিকার সন্ধানে চলে যায় খুলনা। সেখানে গ্রাম দেশের এক আত্মীয়ের বরাতে জুট মিলে শ্রমিকের কাজ জোটে তার। দিন তার খারাপ যাচ্ছিল না সে সময়। সে জুট মিলে কাজ করে আর জমিলা মাটির আলগা চুলা বানায়ে বিক্রি করে। জমিলা কখনো বসে থাকা মেয়ে মানুষ না, সব সময় কিছু না কিছু করছে। তার চুলো বেচা কেনার ব্যবসাও বেশ জমে উঠেছিল, কিন্তু বিধী বাম! একদিন জুটমিল বন্ধ হয়ে গেল। শ্রমিকরা সব হয়ে পড়ল বেকার - দিশেহারা। 

জমিলার যা পয়সা জমেছিল তা অল্প কয়দিনেই ফুরিয়ে গেল। চুলোর ব্যবসাও চুলোয় ওঠার পালা। শ্রমিকদের বস্তিতে কেউ খেতে পায় না দু বেলা, চুলা কিনবে কে? না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছিল সবার। বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরি এলাকা ছেড়ে মানুষ ছুটছে জীবিকার সন্ধানে দূর দূরান্তে। আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে আসছে গোটা শ্রমিক বস্তি এলাকা। এখানে আর নতুন কোনো ফ্যাক্টরি ওঠার সম্ভাবনা নেই। রহমকেও ছুটতে হয় নিত্য নতুন জীবিকার সন্ধানে। 

রহম জমি জমার কাজ ছাড়া আর কিছু জানে না। শিকড় উপড়ে ফেলা গাছের মতো নির্জীব হয়ে পড়ে তার ভেতরটা। কি করবে এখন সে! জীবিকার তাড়নায় এখানে এসে সে মিলের কাজ শিখে নিয়েছিল। কিন্তু রিক্সা চালাতে জানে না। দু একবার চেষ্টা করে দেখেছে। রাস্তায় নামলে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায় এই বুঝি ট্রাকের তলায় পড়বে। অগত্যা রাজমি¯ত্রীর সাথে লেবার এর কাজ নেয় সে। ভোর বেলায় শীতের কুয়াশা ভেদ করে গিয়ে বসে সিএন্ডবি রাস্তার পাশে। যেদিন কাজ থাকে, কেউ না কেউ ডেকে নেয়। আর যেদিন কাজ নাই, ওভাবেই বসে থাকে দীর্ঘণ! দুঃশ্চিন্তায় মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে, শুন্য হাতে কীভাবে বাড়ি ফিরবে! ঘরে অভুক্ত কতগুলো মানুষের মুখ মনে হলেই ভেতরটা গুলিয়ে ওঠে তার। তারপরও রহম তার ভয়কে জয় করতে পারে না, ঐ দিনের জন্য খুঁজে নিতে পারেনা অন্য কোন কাজ। 

জোগার এর কাজে দুই হাতে কড়া পড়ে গেছে তার। চারতলা পাঁচতলা নির্মানাধীন উঁচু উঁচু দালানে ইট,বালি, খোয়া নিয়ে উঠতে গিয়ে হাত পা শির শির করে অনভ্যস্ত নির্মাণ শ্রমিক রহমের। পেটের ভেতর গুর গুর করে, কী এক শুন্যতা এসে ভর করে শরীরে, মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাবে সে। সব শেষ হয়ে যাবে! কিন্তু না, কিছুতেই না। এক পা ও ভুল ফেললে চলবে না তার। কতগুলো মুখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক মুহূর্তের অসতর্কতায় চলে যেতে পারে তার জীবন! ভেসে যেতে পারে তার সংসার-সন্তান! ভীষণ সতর্কতায় একটুও দুর্ঘটনার আশঙ্কাকে প্রশ্রয় না দিয়ে দ্রুত কাজ করে যায় সে। 

দুপুরে রাজমিস্ত্রী ও অন্য লেবাররা যখন খেতে চলে যায়। রাস্তার ধারের ছাপড়া হোটেলে বসে খায় ভাত মাছ বা রুটি তরকারী। রহম ওদের সাথে যায় না। অত খরচ করার মতো পয়সা তার নেই। রহম তখন পলেস্তারা হীন অসম্পূর্ণ দেয়ালের পাশ ঘেসে বসে তার গামছার পুটলি থেকে বের করে আনে ভূসি মেশানো আটার রুটি আর ভেলি গুড়। হোটেলে বসে দুটো পয়সা বেশি খরচ করে রুটি তরকারি খাবার সময় তখন তার নয়। 

সেদিনও দুপুরে রুটির মোচাটা খুলে বসেছে এমন সময় কাজের বাড়ির একজন এসে খবর দেয়, রহম ভাই, সাহেব তোমারে দেখা করতি বলিছে। রহমের বুকটা তখন কেঁপে ওঠে, কেন? কাজে কি কোন ভুল হলো? গালাগালি করে ছাড়ায়ে দেবে এুনি! কোনমতে নাকে মুখে খাওয়া শেষ করে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে সে দাড়ায় সাহেবের সামনে। 
সাহেব রহমকে দেখে বলে বসো।
সে ভীষণ সঙ্কোচে সিড়ির এক কোণে গুটি শুটি মেরে বসে। 
সাহেব কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, আচ্ছা রহম তুমি আমার ঘেরে কাজ করার জন্য একজন লোক দিতি পারবা? লোক? 
হ্যাঁ। আসলে তোমার মতো হলে ভাল হয়। সাতক্ষীরায় আমার তিনটা ঘের আছে। কিন্তু কর্মচারীরা সব হলো চোরের আখড়া। একটাও মন দিয়ে কাজ করবে না খালি চুরির ফন্দি আঁটে। আমি টের পাই কিন্তু উপায় নাই। তাই যদি একজন বিশ্বস্ত লোক দিতি পারতা। তোমার কাজ করার ধরণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতার এই যে এক মনে কাজ করে যাও, এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে তাই যদি তোমার মতো একজন লোক পেতাম! 

রহম যেন পা এর নীচে মাটি ফিরে পেল। ভীষণ বিনয়ে সে বলল, সাহেব যদি আমারে নিতেন, আমি ওইসব কাজই ভাল পারি। সত্যি কতি গেলি এ সব করি পেটের দায়ে। 
সাহেব যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি সাথে সাথে রাজি হয়ে যান। 

এবারও আল্লাহর রহমত থেকে বেশিদিন বঞ্চিত থাকতে হলো না রহমকে। বৌ ও দুই শিশুকন্যা সমেত রহম এবার পাড়ি জমায় সাতক্ষীরায়। ঘেরে দিন রাত খাটুনি। তারপরও রহমের ক্লান্তি নেই। এভাবে কাজ করতে করতে মালিকের নেক নজরে পড়ায় তার বেতন বাড়ে। যারা লাখ লাখ টাকার মাছ কেনে বেচে ঐ ঘেরে তাদের কাছ থেকে কিছু কমিশনও পায় মাঝে মাঝে, আর তাতে করে রহমের কিছু পয়সাও জমে যায়। জমিলাও কাজ করত খটিতে, চিংড়ির মাথা খোলার কাজ। দু’জনের জমানো টাকায় তারা চিংড়ি খটি ব্যবসায় লগ্নি করে। কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে তাদের ভালই লাভ হয়েছিল আর সেই টাকা দিয়ে তারা সেখানে বিঘে দুই জমিও কিনে ফেলে। 

রহম আর জমিলার চোখে সেদিন তারার ঝিলিক- তাদের নিজেদের জমি। এতবড় পৃথিবীতে তাদেরও আছে একখন্ড ভূমি। ডাল সিজনে যখন খটি উঠে যায় তখন রহম তার জমিতে কৃষি কাজে মন দেয়। জমিলা ও রহম মিলে আবারো সোনা ফলায় জমিতে। সোনালী ফসলে ভরে যায় তাদের ছোট্ট উঠোন। সন্তানদের স্কুলে পাঠায় তারা। 

কিন্তু হঠাৎ কি যে হলো, দু-তিন বছর যেতে না যেতেই বর্ষা মৌসুমে পানি উঠলো জমিতে। বর্ষা পেরিয়ে হেমন্ত এলো, পানি আর টানে না। লোনা পানিতে ভরে যেতে থাকে জমি। জমিতে পানি শুকায়-ই না। সব সময় হাটু অবধি জল। ধান ফলে না, মাছই একমাত্র ভরসা। সেই মাছেরও একদিন একি চেহারা! 

মাংশ বিহীন শুধু খোসা নিয়ে জালের এক কোণে লেপ্টে আছে চিংড়ি মাছের কিছু কঙ্কাল। চিংড়ি কোথায়, চিংড়ি? হাহাকার করে ওঠে রহম। লক্ষ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করেছে মানুষ লোনা পানির ভেতরে, গেল কোথায় তারা সব? কিছুদিন আগেওতো ঝটকা মারতে দেখা গেছে ৪০ গ্রেডের চিংড়ি অথচ গোণের সময় একি! শুধু খোসা! পানির মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে রহম দিশেহারার মতো খুঁজতে থাকে চিংড়ি নামের সোনার হরিণ। আর তার বদলে দুহাত ভরে উঠে আসে তাল তাল কাদা আর তার ভেতরে বিচ্ছিন্ন খোসা। এর নাম নাকি ভাইরাস। 
শহর থেকে আসে বড় বড় বিশেষজ্ঞ। তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানি নাকি বেড়ে গেছে তাই এই দশা। কোথায় যেন বরফ গলে যাইতেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, না কি যেন.. শক্ত শক্ত কথা বলেন তারা। রহম অত কিছু বোঝে না। সে শুধু দেখে জমি ভরা পানি। খাবার পানি না, নাইবার পানি না তারপরও পানি। হায়রে পানি! চোখের পানি আর সেই পানিতে একাকার হয়ে যায় জীবন। আর সেই পানি নামতে না নামতে আসলো আইলা। এবার বসত ভিটায়ও উঠে গেল পানি, আর নামার নাম নাই। রহম তখন কি করে! সে তিন ছেলেমেয়ের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে পারে না। 

আবার সে জমিলাকে নিয়ে পাড়ি জমায় অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গার সন্ধানে। ওখান থেকে পূর্ব দিকে পিরোজপুরের এই মূলগাঁও এ এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে এসে ওঠে। কয়রার জমি বেচে খুব কম টাকাই পেয়েছিল তারা। পানির দামে বেচা সেই টাকায় এখানে জমি কেনা যায় না। তারপরও রহম আলী তার সেই আত্মীয়ের মাধ্যমে ২ কাঠা জমি কেনে মূলগাঁও-এ। সেই জায়গায় সে একখানা ছোট্ট ঘর তোলে, চারপাশে করে সবজির বাগান। কিন্তু জমিলার মনের মধ্যে সব সময়ই খচ খচ করে। ঐ আত্মীয়ের হাব ভাব তেমন ভালো ঠেকে না জমিলার। স্বামীকে তাগাদা দেয়- জমি রেজিস্ট্রি করে নিতে বলে জলদি।

কি ভাই জমিটা রেজিস্ট্রি কইরে দিলে না! একদিন সুজোগ বুঝে কথাটা পাড়ে রহম।
দিবানে, অত তাড়া কিসের থাকতে লাগো কিছুদিন। 
ফের আর একদিন তাগাদা দিলে আত্মীয় বলে, ঐ টাকায় কি এই জমি হয়! আরো কিছু টাকা বাড়াও রেজিস্ট্রি কইরে দি। কেঁপে ওঠে রহমের ভেতরটা, কয়কি বেটা! কিন্তু ভাই এমন কতাতো ছেলো না! আরো টাকা এখন কই পাবো? 
চেষ্টা করতি থাকো পারবানে। আর না পারলি যে টাকা দিছিলা ফেরত দিয়ে দেই উইঠে যাও। একজন ভালো রিদ্দার কিছুদিন ধইরে জায়গাডা চাচ্ছে.. এবার সে গলাটা নামিয়ে বলে, মালদার পার্টি, বিদেশে থাকে, বলার ভঙ্গিতে তার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকা লোভের লালা কোনো মতে টেনে নিয়ে গিলে ফেলে সে নেড়ি কুকুরের বিষ্ঠা খাওয়ার ঢঙে।। 
তুমি এসব কি কতিছ ভাই! টাকা দিলাম, জমি আমারে দিলে, সেখানে আমি ঘরও তুললাম, এতদিন থাকলাম এখন এসব কি কও? এই পৃথিবীতে এখন জবানেরও কোনো দাম নেই? টাকাই সব! 
তুমি যে জমি কিনেছিলে তার কি কোনো প্রমাণ দেহাতি পারবা? খেকিয়ে ওঠে সে।
না, কিন্তু তুমিতো জান। 
আমি জানলি কি হবে! শালিশদাররা তো কেউ জানে না। শুপারির খোলের পরতে প্যাঁচানো তামাকের বিড়িতে টান দিয়ে উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে বলল, তার চেয়ে ভালয় ভালয় জমিটা ছাইড়ে দাও, টাকা কিছু দেবানে তাতে আমারও উপকার তোমারও উপকার। আর তা না হলি তো বোঝ, নতুন জায়গা, আমি তোমারে আনিছি। কেউ তোমারে চেনে না, কথা শেষ করেনা সে। 
রহম তখন কোথায় যায়, কি করে! 

টাকা পয়সা হয়ে বারেকও গ্রামে বেশ প্রভাবশালী। বিচার শালিশে তারও ডাক পড়ে। তো রহম তার কাছে নিজের দু:খের কথা খুলে বলে। 
বারেক বলে, দেখবানে কি হয়। তুমি আমার সাথে কয়দিন কাজ কর তো রহম ভাই! 

দিনের পর দিন বারেকের সাথে সে কাজ করে। জমিলারও ডাক পড়ে বারেকের ভেতর বাড়িতে। ধান ভানা, মুড়ি ভাজা, চিড়ে কোটা এ সব কাজ যে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই বারেকের মা, বৌ এর সাথে করে দেয়। বারেকের বউটা ভালো, সে জমিলাকে বিনিময়ে এটা সেটা দিতে চায়। জমিলা সবিনয়ে বলে, না কিছু লাগবেনা বইন। বারেকের বৌ ও নাছোড়বান্দা, সে জমিলার ছেলে মেয়ের জন্য মুড়ি চিড়ে পাঠিয়ে দেয়। দুজনের মধ্যে গভীর ভাব জমে ওঠে। যেখানে কোনো স্বার্থের সূতো ছিল না হয়তো। 
এদিকে রহম-জমিলারা ততদিনে ঐ বাড়িতে আর থাকতে পারছিল না। জমিওয়ালা রহমকে তাড়ানোর জন্য এখন রাত হলেই তার ঘরের চালে ঢিল মারে। ঘরের বাইরে বের হলেই ছাপার অযোগ্য গালি। রহমের তখন দিশেহারা অবস্থা না থাকতে পারে ঘরে, না বাইরে। ছেলে মেয়ে বৌ নিয়ে এখন কোথায় যায় সে! 

সেদিন রহমের দুঃখের কথা শুনে বারেক তাকে তার মণিবের ঐ দণি ভিটার পতিত জমিতে গিয়ে থাকতে বলেছিল। নিরুপায় রহম তাই করে। কিন্তু সেই বারেকও এখন এসব কি বলতিছে! 

বারেক দীর্ঘদিন ধরেই চাচ্ছিল খানা-খন্দ আর বড় বড় গাছের মুড়োয় ভরা ঐ পতিত জমি আবাদ করতে। কিন্তু তাতে অনেক পয়সা খরচ হয়ে যায়। বারেকের সেই পয়সা খরচ করার ইচ্ছে ছিল না। ওদিকে জমি খাবার ইচ্ছে ষোল আনা। রহম আর ওর বৌ’র কাজ করার ক্ষমতা জানে বারেক। অশুরের মতো খাটতে পারে দুজনে। বারেকের ধারণাকে সত্য করে দিয়ে ঐ জমিতে কতো তাড়াতাড়ি সোনা ফলিয়েছে ওরা দুজন। এখন তো আর ঐ জমি ওদেরকে ভোগ দখল করতে দেয়া যায় না। আসছে বছর তার মনিব আসবে, সে যদি এসে রহমের এই ম্যাজিক দ্যাখে তাহলেতো আর ওগের নামাবে না। বরং বারেকের ভোগ দখল থেকেও কিছু কমতে পারে। না, এই ভুল করা যায় না। নিজের কপালে নিজে লাথি! না, কিছুতেই তা হয় না। বারেক তখন সারাক্ষণ ফন্দি আঁটে কি বলে ওকে তাড়ানো যায়। বুদ্ধি বের করে একদিন মুখ ব্যাজার করে বরফ কলের গল্প ফেঁদে বসে সে। 
রহমের সেই কল্পিত গল্প মেনে না নেয়া ছাড়া উপায় নেই। শিশুর হাত থেকে খেলনা বা কাঠি-চকলেট কেড়ে নিলে যেমন কাঁদে সেই ভাবে কাঁদতে লাগল রহম। জমিলাকে আসতে দেখে সেই ধারা মুছলো সে গামছার খুঁটে। জমিলা দেখেও যেন দেখল না। তার ভেতরেও রক্তরণ হয় কিন্তু বুঝতে দেয় না। দুজনেই যেখানে একই দুঃখের অংশীদার সেখানে একজনকে তো শক্ত থাকতেই হবে। নইলে যে সব শেষ হয়ে যাবে।

রহম না বুঝলেও জমিলা জানে এটা বারেকের চালিয়াতি। অথচ রা কাড়ার উপায় নেই তাদের। জমিলা ইদানিং টের পায় রাতের বেলা কে বা কারা ঘুর ঘুর করে বাড়ির চারপাশে। ধারাল অস্ত্র হাতে কেউ বসে থাকে পুকুর ঘাটে যেতে ঐ কলা ক্ষেতের পাশে। চাঁদের আলোয় সান দেওয়া সেই জিনিসটা ঝলকে ওঠে। ওরা এখন রাতের বেলা বাইরে যেতে সাহস করে না। ধারালো অস্ত্রের মুখে এখন ওদের জীবন তারপরও পায়ের নিচে মাটি আছে। আর এই মাটি রাখতে গেলে জীবন যে আর থাকে না। সেই জীবনের তাগিদেই একদিন ভূমিহীন ভাসমান অসংখ্য মানুষের মতো ওরাও পাড়ি জমায় এক অজানা অচেনা হৃদয়হীন নগরীর দিকে।

লেখক: ছোট গল্পকার
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক সংবাদ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত