নিশ্ছিদ্র অন্ধকার

প্রকাশ : ২১ মে ২০১৭, ২০:৩৬

মেহেদী হাসান

গৃহবধূ সালেহা ফাঁদে আটকে পড়া অসহায় বন্য পশুর মত চেয়ারম্যানের ছেলে কাদেরের শক্ত হাতের আবেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়ে যায় শুধু, সুতীক্ষ্ণ তীরের মত কোন চিৎকার তার মুখ ফুঁড়ে বের হয়ে আসে না। চিৎকার করলেই কি সে রেহাই পাবে? ফাঁদে আটকা পড়া হরিণ কি চিৎকার করে নিস্তার পায়! বরঞ্চ লোকজন এগিয়ে এসে খুশিতে হাততালি দিয়ে ওঠে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মজা দেখে। 

বরঞ্চ তার চেঁচামেচির শব্দ শুনে আশেপাশের মানুষ জড়ো হয়ে তাকে এই জন্তুটির হাতে সঁপে দিয়ে তার নামে নানা ধরনের কুৎসা রটাতে রটাতে চলে যাবে- “তলে তলে এত কিছু, মুখ দেইকা তো কোন কিছু বোঝনের উপায় নাই। ভাব-সাব দেইখ্যা মনে অয় কত সতীসাধ্বী- আবার মাগীর ঢং দেখ, ডাকাডাকি কইরা লোক জমাইছে। আরে ঢং না ঢং না, বোঝস না তো তোরা, রাইতে রাইতে দেহা কইরা আর তৃষ্ণা মিটতাছে না, কাদেরের ঘরে যাবার চায়, হারা দিন-রাইত ভইরা সোহাগ পাবার চায়। চেয়ারম্যান বাড়ির বউ অওনের শখ জন্মাইছে মাগীর! ঝাটা মারি অমন মেয়ানোকের মুখে”। 

যে মানুষগুলোকে সে তার এই বিপদের মুহুর্তে ডাকতে চাইছে তারাই তার উপর দোষের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে, নানা ধরনের রসালো কাহিনীর সূত্রপাত ঘটাবে। বছরের পর বছর ধরে সেই কাহিনী এই এলাকা ও তার বাবার বাড়ির এলাকার মানুষজনের মুখে মুখে ঘুরতে থাকবে- মাগী আগের থাইকাই খারাপ আছিল, দেহস না মাগীর শরীলডা- সাত গাঙ্গের পানি না খাইলে কি এত তেল জমে! জামাই তো কত বছর ধইরা বিদেশ, এত দিন কি মাগী একা একা থাকছে, মনে করস? মাগী যে কতজনের নগেই হুইছে তার কি আর কুন হিসাব আছে।

তার মা ঘরের মেঝেতে বসে হাহাকার করে কাঁদতে থাকবে। লজ্জায়-অপমানে তার বাবা ঘর থেকে বের হতে পারবে না। গ্রামের বড় উঠানে সালিশ বসবে। এককোনায় চোরের মত দাঁড়িয়ে থাকা তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে গ্রামের মাতাব্বরেরা বলতে থাকবে- “তোমার মাইয়ার জন্য আমরা গ্রামের বাইরে মুখ দেহাইতে পারি না, আগে আমাগো গ্রামের কত মান-ইজ্জ্বত আছিল, তোমার নষ্টা মাইয়ার কারণে সব শেষ হইয়া গেল। আমরা গ্রামের দশ-জনে মিলে তোমাগো আটক রাখলাম। তোমরা গ্রামের কোন মানুষের সাথে মিশতে পারবা না, সমাজের কোন কাজে যোগ দিবার পারবা না, সমাজের কেউ তোমাগো কুরবানির মাংশ খাব না”। সালিশের অন্যান্য লোকজন চিৎকার করে উঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলবে, “না আমরা এই বিচার মানি না। খালি আটক রাখলেই চলব না, বাড়ি-ঘর ভাইঙ্গা গ্রাম থিকা জন্মের মত বাইর কইরা দেওন লাগবো”।

এই ঘটনার অনেক বছর কেটে গেলে, তার সাত বছরের ছোট বোনটি যখন বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠবে তখন তার বিয়ে হবে না। “অর বড় বুইনডা আছিল খারাপ, আর ও কি বালা অইবো, পথম হাল যেন দিয়া যায়, পরের হালও অইদিক দিয়াই যায়।”

সৌদি-আরব থেকে তার স্বামী কালকেই রেজিষ্ট্রি করে তালাকনামা পাঠিয়ে দেবে। 

তার ছেলেটার জন্ম পরিচয় নিয়ে সকলে সন্দিহান হয়ে উঠবে- “দেক, দেক, পোলাডার চেহারার দিকে চাইয়া দেক, রফিকের নাগাল এট্টুও দেহা যায় না। জামাই থাকে বিদেশ, কুন থিকা জাইরা পেট বানাইছাল কব কেরা। তোমাগো পোলাপানরে কইল ঐ জাইরা পেটের পোলার নগে মিশবার দিও না”। 

লাভ হবে শুধু কাদেরের। তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শকুনের মত তার শরীরটাকে দিন-রাত ধরে খুবলে খাবে যতদিন পর্যন্ত না তার তিয়াস মেটে। তারপর অন্য একটি নতুন শরীর ভালো লেগে গেলে এক লাত্থিতে বাড়ির বাইরে বের করে দিবে। 

এসব ভাবনা কোত্থেকে কোত্থেকে দৌড়ে এসে তার মাথার মধ্যে জড়ো হয়ে উদ্বাহু নৃত্য শুরু করে। তার ভেতর থেকে জেগে উঠা বিদ্রোহ এতক্ষনে মাথার ভেতরে নৃত্যরত এসব ভাবনার পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বদলে একটি ভয় ধোঁয়ার মত কুন্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে সালেহার শরীরটাকে নিস্তেজ করে ফেলে। চারপাশের ঝাপসা অন্ধকার ধীরে ধীরে বিশাল এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে। বিস্ফোরিত চোখে রাতের আঁধারকেও আর দেখতে পায় না সালেহা। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত