এসো পা বাড়াই (২১ তম পর্ব)

প্রকাশ : ১৮ মে ২০১৭, ০৩:০৯

"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"

LEAN IN                                                                 এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD         নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG                           অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি

একজন পুরুষকে যদি তার সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, সে তার সহজাত গুণাবলী এবং দক্ষতার কৃতিত্ব নিবে। একই প্রশ্ন যদি একজন নারীকে করা হয়, সে বাহ্যিক নানা কারণকে নির্দেশ করবে, জোর দিয়ে বলবে যে সে ভালো করেছে কারণ সে “সত্যিই কঠোর পরিশ্রম” করেছে অথবা “সে ভাগ্যবান” অথবা “অন্যদের অনেক সাহায্য” সে পেয়েছে। ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যখন একজন পুরুষ অকৃতকার্য হয় সে এমন সব কারণ নির্দেশ করে যেমন, “পর্যাপ্ত পড়াশুনা” করেনি অথবা “এই বিষয়-বস্তুর প্রতি আগ্রহ নেই” তাই ভালো করেনি। যখন একজন নারী অকৃতকার্য হয়, সম্ভবত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে বিশ্বাস করে যে অন্তর্নিহিত অযোগ্যতার কারণেই তা হয়েছে। এবং যেসব পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষ উভয়ই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পায়, সেসব ক্ষেত্রে নারীদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদাবোধ অনেক বেশী মাত্রায় কমে যায় পুরুষের তুলনায়। ব্যর্থতার অভ্যন্তরীনকরণ এবং নিরাপত্তাহীনতা ভবিষ্যতের কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এভাবে এই নিদর্শন গুরুতর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

আর শুধু নারীরাই নিজেদের প্রতি নিজেরা কঠোর তা নয়। তাদের সহকর্মী আর গণমাধ্যমও খুব দ্রুত নারীদের সাফল্যের ক্ষেত্রে বাহ্যিক কারণগুলোকে কৃতিত্ব দিয়ে দেয়। ফেসবুক যখন সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশিত হলো তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times) এ একটি প্রবন্ধ বের হয়েছিল যা আমাকে এবং অন্য সবাইকে সদয়ভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিল, “ক্ষমতাবান পরামর্শদাতা আর সৌভাগ্য ছিল আমার চলার পথের সাথী”। সাংবাদিক এবং ব্লগাররা টাইমসের দ্বিমুখী মানদণ্ডের নীতিকে সবার দৃষ্টিগোচর করতে উঠে পরে লেগেছিলেন। তারা এই দিকে নির্দেশ করছিলেন যে নিউ ইয়র্ক টাইমস কদাচিৎ পুরুষদের সাফল্যকে ভাগ্য বলে বিবেচনা করে। কিন্তু যা আমি নিজেকে হাজার বার বলেছি তার থেকে নতুন কিছু টাইমস বলেনি। আমার কর্মজীবনের প্রতিটি পর্যায়ের সাফল্যকে আমি ভাগ্য, কঠোর পরিশ্রম আর অন্যদের সহায়তার কারণ বলেই ভেবেছি।

যেভাবে অধিকাংশ নিরাপত্তাহীনতা শুরু হয়, সেভাবেই উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার নিরাপত্তাহীনতার শুরু। আমি মায়ামির একটি বড় পাবলিক স্কুলে পড়েছিলাম- দ্রুতগতিতে রিজমন্ট হাই (Ridgemont High) এর সময়ের কথা চিন্তা করি- ঐ সময় স্কুলটি পড়াশোনার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল বারান্দার মারামারি প্রতিরোধ আর বাথরুম থেকে মাদকদ্রব্য বাইরে রাখার কাজে। যখন আমি হার্ভার্ড (Harvard) এ পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তখন আমার হাইস্কুলের অনেক সহপাঠীরাই জানতে চেয়েছিল, কেন গিক (Geek-প্রযুক্তির কাজে ব্যস্ত/অপ্রচলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ) এ ভরা একটা স্কুলে আমি যেতে চাইছি। তারপর তারা একটু থেমে মনে করতো, কার সঙ্গে কথা বলছে এবং উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভয়ে-ভয়ে চলে যেতো, বুঝতে পারতো যে উত্তর তাদের এর মধ্যেই জানা হয়ে গেছে।

কলেজে নব শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বিশাল ধাক্কা খেয়েছিলাম। প্রথম সেমিস্টারে আমি একটি কোর্স নিয়েছিলাম, গ্রীক সভ্যতায় বীরের ধারণা (The Concept of the Hero in Hellenic Civilization) নামে যার প্রচলিত উপনাম ছিল, হিরোস ফর জিরোস (Heroes for Zeroes) । আমার কোন তীব্র বাসনা ছিল না গ্রীক মিথলজি পড়ার, কিন্তু এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ পন্থা সাহিত্যের আবশ্যিক শর্ত পূরণে। অধ্যাপক তার প্রথম ক্লাশ শুরু করেছিল, কে কে এই বইগুলো পড়েছে, এই প্রশ্ন দিয়ে। আমি ফিস ফিস করে আমার পাশের জনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, “কোন বই?” সে উত্তর করেছিল, “অবশ্যই, দ্যা ইলিয়াড ও দ্যা ওডিসি (The Iliad and The Odyssey)। আমি ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই হাত উঁচু করেছিল। এরপর অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে মূল বইটি পড়েছে? আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মূল বই কোনটি? তার উত্তর ছিল, হোমেরিক গ্রিক (Homeric Greek) । ক্লাশের ভালো তিন অংশই হাত উঠিয়ে রেখেছিল। এটা স্পষ্টই মনে হচ্ছিল যে আমি জিরোদের একজন।

(চলবে...)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত