উৎসবে মেতেছে পাহাড়

প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ০১:০৬

জাগরণীয়া ডেস্ক

পানিতে রং বেরঙের ফুল ভাসিয়ে পার্বত্য জেলায় শুরু হয়েছে বৈসাবির মূল আনুষ্ঠানিকতা। আর এর মধ্যে পাহাড়ও এক অদৃশ্য আনন্দে মেতে উঠবে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি পল্লীগুলো। চারিদিকে আনন্দের সুর লহরী আর বৈসাবি আয়োজনে ১২ এপ্রিল (বুধবার) সকাল থেকে বৈসাবি উৎসব শুরু হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মানুষ সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী মানুষ বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনও কোনও জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে। বৈসুকের ‘বৈ’ সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবে উৎসবে একীভূত করার জন্য এই সংক্ষেপে নামটি প্রচলন করা হয়।

উৎসবপ্রিয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠি সারাবছর মেতে থাকেন নানান অনুষ্ঠানে। তবে তাদের সব উৎসবকে ছাড়িয়ে যায় বর্ষবিদায়ের এই উৎসব। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদাভাবে এই উৎসব পালন করে। উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে সেই ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। পবিত্র এই ফুল ভাসিয়ে দেয় পানিতে, তাই একে বলা হয় ফুলবিজু।

ঐতিহ্যবাহী পোষাকে তাদের গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে এদিন শুরু হয় বৈসাবি উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। ফুলবিজুর দিন সকালে রাঙামাটি শহরের রাজবনবিহারের পূর্ব ঘাটে ফুলবিজু উৎসবে কর্ণফুলী নদীতে ফুল ভাসায় চাকমা তরুণীরা। পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো দিনের বেদনা ভুলে নতুন দিনের প্রত্যয়ের কথা জানায় ফুল ভাসাতে আসা পাহাড়ি তরুণ-তরুণীরা। পাহাড়িদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে ফুল হচ্ছে একটা পবিত্র জিনিস।

‘ফুল বিজু’র পরপরই তরুণীরা নিজেদের ঘরে ফিরে যায়। বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। ফুল ভাসানো শেষে বয়স্কদের স্নান করানো হয়। পাড়ার বয়স্কদের শরীরে পানি ঢেলে তাদের আশীর্বাদ কামনা করেন তরুণ-তরুণীরা। দেওয়া হয় নতুন পোশাক। পরেরদিন চৈত্রের শেষ দিনে শুরু হবে মূল বিজু। এদিন সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে কাটায় তরুণ তরুণীরা, ঘরে ঘরে নিমন্ত্রণ আর আতিথিয়েতা গ্রহণের সে এক অনাবিল আনন্দ। 

এদিন ঘরে ঘরে ঐতিহ্যাবাহী খাবার পাঁচন রান্না করা হয়। অতিথিদের মাঝে ঐহিত্যবাহী খাবার ‘পাঁচন’ পরিবেশন আর একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসব তার চিরায়ত ব্যঞ্জনায় রূপ লাভ করে। বহু প্রকার সবজি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই পাঁচন তৈরি করা হয়। পাহাড়িদের বিশ্বাস, এই পাঁচন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া একদিনে সাত পরিবারে এই পাঁচন খেলে সর্বরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। বিজুর দিনে পাহাড়িদের বাসায় পাহাড়ি-বাঙালি সবাই যায়। এদিন ফুটে ওঠে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব।

মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাই উৎসবে- একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে পুরনো বছরের সকল দুঃখ, অবসাদ দূর করে নতুন বছরে শুদ্ধ মননে জীবন শুরুর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। প্রতিবছরই বাংলাদেশ মারমা সাংস্কৃতিক সংস্থার (মাসাস) আয়োজনে কেন্দ্রীয়ভাবে পানি খেলা বা ওয়াটার ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। এবছরও কাউখালী, রাজস্থলীর বাঙ্গালহালিয়ায় ও কাপ্তাইয়ের চিৎমরমে পানি খেলার আয়োজন করা হয়।

এছাড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা পালন করে আসছে। বৈসাবিতে গ্রামীণ বাংলার বিভিন্ন খেলাসহ পাহাড়ি ঐতিহ্যগত বিভিন্ন খেলা যেমন-ঘিলা, তব্রু খেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়া ফুলবিজুতে রাতের আকাশে অপূর্ব পানুসের ঝলক দেখা যায়। বিজুর পক্ষকাল আগে থেকেই রাঙামাটিতে বিজুর আগমনীর সুর চলছে। বৈসাবিকে সামনে রেখে আদিবাসী মেলা, পার্বত্য মেলা, পাঁচন তৈরি প্রতিযোগিতাসহ আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

এদিকে, গত ৬ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) ভোর ছয়টায় জেলার চেংগী-মাইনী ও ফেনী নদীর বিভিন্ন স্থানে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিঝু উৎসব পালন করেছে চাকমারা। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে চাকমা পুরুষ-মহিলা, তরুণ-তরুণিরা ও শিশুরা নদীতে ফুল ছাড়ার পাশাপাশি মোমবাতি জ্বালিয়ে ও দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে তারা। এছাড়াও শত বছরের প্রথা অনুযায়ী ১২ এপ্রিল (বুধবার) চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন মূল বিঝু এবং ১৩ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) গইজ্যা-পইজ্যা পালন করবে।

আর এভাবে চাকমারা নদীতে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরন করে নেয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত