জহির রায়হান চলচ্চিত্র উৎসবে সুন্দরবন রক্ষার প্রত্যয়

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০১৬, ১৯:৫৬

জাগরণীয়া ডেস্ক

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং সুন্দরবন রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে “প্রতিরোধে প্রস্তুত ক্যামেরা”- এই শ্লোগানকে ধারণ করে উদযাপিত হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত “জহির রায়হান চলচ্চিত্র উৎসব”। উৎসবে সাধারণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে চলচ্চিত্র মাধ্যমকে আরো বেশি করে কাজে লাগানোর প্রত্যয়ও ব্যক্ত করা হয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জহির রায়হান-এর ৮১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার (১৯ আগস্ট) উদযাপিত হয় এ উৎসব। শুক্রবার সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় গণ-গ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ আয়োজিত এ উৎসবের উদ্বোধন করেন বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারে হাসিন মুরাদ।

“প্রতিরোধে প্রস্তুত ক্যামেরা”- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজিত দিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধনী পর্বের শুরুতে জহির রায়হান পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র “জীবন থেকে নেয়া”-এর চারটি গান পরিবেশন করেন উদীচী মিরপুর শাখার শিল্পীরা। এগুলো হলো- “ও আমার স্বপ্ন ঝড়া আকুল করা জন্মভূমি”, “দাও দাও দুনিয়ার যতো গরীবকে আজ জাগিয়ে দাও”, “কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট” এবং “এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে”। 

এরপর উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা পরিবেশন করেন “আনন্দ লোকে, মঙ্গলালোকে বিরাজ সুন্দর” এবং “কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো” গান দু’টি। এছাড়া, “যখন তোমার ভাঙ্গবে ঘুম সেটাই তোমার সকাল” গানটির সাথে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচী’র নৃত্যশিল্পীরা।

এরপর জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন উৎসবের উদ্বোধক চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারে হাসিন মুরাদ। আর সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী ও উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ। 

এরপর উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ-এর সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। এ পর্বের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। এছাড়াও, বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী, সহ-সভাপতি শংকর সাওজাল, জহির রায়হান-এর ছেলে অনল রায়হান এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা মশিউদ্দিন শাকের।

বক্তারা বলেন, জহির রায়হান যে দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুব্ধ হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সেই আদর্শকে বুকে ধারণ করেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হলে চলচ্চিত্র আন্দোলনকে নতুন করে গুছিয়ে তোলা উচিত বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা।

একইসাথে সাধারণ মানুষের ন্যয়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে চলচ্চিত্র মাধ্যমকে আরো বেশি বেশি করে কাজে লাগানোর তাগিদও দেন আলোচকরা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের নানা পর্যায় এবং ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি জহির রায়হান-এর জীবন, কর্ম ও আদর্শ নিয়ে বক্তব্য রাখেন উদ্বোধনী পর্বের বক্তারা। উদ্বোধনী পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান।

উদ্বোধনী পর্বের পর মিলনায়তনের ভেতরে শুরু হয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন পর্ব। শুরুতেই প্রদর্শিত হয় জহির রায়হান নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নৃশংসতম গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল এই প্রামাণ্যচিত্র। এরপর প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’ প্রদর্শন করা হয়। এ সিনেমার প্রদর্শন শেষে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন নির্মাতা মশিউদ্দিন শাকের। 

এরপর সেন্টু রায় নির্মিত জহির রায়হানের জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জহির রায়হান’ প্রদর্শন করা হয়। এ চলচ্চিত্রটির পর ছিল ভারতীয় নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘এ লেটার টু মাই ডটার’-এর প্রদর্শনী। সবশেষে প্রদর্শিত হয় কামার আহমাদ সাইমন নির্মিত আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শুনতে কি পাও’। এছাড়া, ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচী’র দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে চালানো বোমা হামলা থেকে শুরু করে ২০০৫ সালে উদীচী নেত্রকোনা জেলা সংসদ কার্যালয়ে চালানো বোমা হামলার ঘটনা পর্যন্ত সংঘটিত বাংলাদেশের ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক বোমা হামলাগুলোর ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্ষতচিহ্ন’ প্রদর্শিত হয়। এ প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছে উদীচী কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগ।

বাংলাদেশে বর্তমানে জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এ দেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সদা তৎপর উদীচী। গান, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তির পাশাপাশি উদীচী মনে করে চলচ্চিত্র মাধ্যমকেও এ লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা উচিত। আর সেই লক্ষ্য থেকেই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং সুন্দরবন রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে “প্রতিরোধে প্রস্তুত ক্যামেরা”- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে উদীচী আয়োজন করে “জহির রায়হান চলচ্চিত্র উৎসব”। 

বর্তমান সময় এবং উৎসবের মেজাজের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এবারের উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্বাচন করা হয়। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত এ উৎসব চলবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত