কামিনী রায়ের কবিতায় সমবায়চিন্তা

প্রকাশ : ২৫ মে ২০১৬, ১৬:৫৮

ড. তপন বাগচী

ষোড়শ শতকের কবি চন্দ্রাবতী, অষ্টাদশ শতকের কবি রহিমুন্নিসার পরে উনিশ শতকে আমরা কামিনী রায়ের আগে উল্লেখযোগ্য নারীকবি হিসেবে পাই নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২), করিমুন্নো খানম চৌধুরানী (১৮৫৫-১৯২৬), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) এবং মানকুমারী বসুকে (১৮৬৩-১৯৪৩)। কামিনী রায়ের সমকালীন আরেক কবি-অনুবাদকের নাম আজিজুন্নেছা খাতুন (আনু. ১৮৬৪-১৯৪০)। এই তালিকা থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যায় যে, চন্দ্রাবতীর পরে প্রথম সার্থক কবির নাম কামিনী রায়। এই পথ ধরেই আমরা বেগম সুফিয়া কামাল কিংবা পরবর্তী নারী কবিদের সৃষ্টিসাফল্য প্রত্যক্ষ করি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) অসংখ্য স্মরণযোগ্য কবিতা লিখেছেন। কিন্তু আমাদের তাৎক্ষণিক স্মরণে আসে শ’খানেক মাত্র। মাইকেল-নজরুল-সুকান্ত-জসীমের ক্ষেত্রেও সমানুপাতের হিসাব মেলানো যায়। এই ধারার বাইরে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত তিরিশের আধুনিক পঞ্চপান্ডবের নাম একত্রে উচ্চারিত হয়। কিন্তু জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুধীনের পরে বিষ্ণু-অমিয়র স্মরণযোগ্য চরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রবীন্দ্রবলয় এবং তিরিশি ঘরানার বাইরেও রয়ে গেছে বিশাল এক কবিগোষ্ঠী। হাজারো ডামাডোলের ভেতরেও তাঁদের অনেকেরই নাম টিকে আছে। ‘কাজলাদিদি’ এবং ‘অন্ধবধূ’র কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর (১৮৭৮-১৯৪৮) নাম কে না জানে? আর সকল রচনাকে পাশে ঠেলে রেখেও আমরা এই দুটি কবিতার জন্য অন্তত তাঁকে বাংলা কবিতার আসরে স্থায়ী আসন দিতে চাই। তাঁর ‘দিদিহারা’ কবিতার নাম পাঠকেরাই নতুন করে ‘কাজলাদিদি’ রেখেছে।

সমকালীন আরেক কবি কামিনী রায়কেও আমরা অন্তত তিনটি কবিতার জন্য চিরদিন মনে রাখতে পারি। কবিতা তিনটির শিরোনামের চেয়ে ভেতরের চরণই বেশি মনে থাকে। ‘করিতে পারি না কাজ, সদা ভয় সদা লাজ’, ‘নাই কি রে সুখ, নাই কি রে সুখ, এ ধরা কি শুধুই বিষাদময় ?’ এবং ‘পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মতো কেন বলিস ?’ এই চরণের ধারক কবিতাত্রয় কেবল নারীকবির উচ্চারণ হিসেবে নয়, বাংলা কবিতার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটেই বিচার্য। কামিনী রায় উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে অনার্সসহ গ্রাজুয়েট। বেথুন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বিচারক পিতা চন্ডীচরণ সেন সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। পারিবারিক আভিজাত্য, শিক্ষা ও রুচি তিনি ধারণ করতেন সৃজনে-মননে। উনিশ শতকের শেষ পাদের কবি হয়েও তাঁর রচনা যথেষ্ট মার্জিত এবং আধুনিক চিন্তাচেতনার বাণীবহ। শিক্ষা এবং পারিবারিক সংস্কৃতিই তাঁকে সমকালের নারী কবিদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে, একথা ভাবার কারণ থাকলেও আমরা লক্ষ করি যে, তিনি সাহিত্যচর্চাকে কেবল শখের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেননি। এটি ছিল তাঁর আত্মনিবেদনের প্রধান ক্ষেত্র। সাধনার মাধ্যমেই তিনি এই পথে অগ্রসর হয়েছেন এবং সিদ্ধি লাভ করেছেন। আমাদের খেয়াল রাখতে হয় যে, রবীন্দ্রনাথের মাত্র তিন বছর পরে এসেছেন কামিনী রায়। রবীন্দ্রযুগে জন্ম নিয়ে কবি হিসেবে টিকে থাকাটাই অনেক বড় ব্যাপার। রবিরশ্মির তেজ এত তীব্র যে, আশেপাশের আর কোনো আলো কারো চোখে পড়ার কথা নয়। রবীন্দ্র-অনুসারী যে কবিসমাজ গড়ে উঠেছিল, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ নিয়ে জ্বলেছেন এবং জ্বেলেছেন। কিন্তু আমাদের কামিনী রায় ছিলেন একেবারে রবীন্দ্রকুন্ডের মধ্যিখানে। সেখান থেকে নিজের আলো বিচ্ছুরণ করা দারুণ দুরূহ কাজটিই তিনি করেছেন।

নিজের মতো করে কবিতা লিখেছেন। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৯০৩) ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ করেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া (১৮৮৯)। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো: নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), গুঞ্জন (১৯০৫), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোকসঙ্গীত (১৯১৪), অম্বা (১৯১৫), বালিকা শিক্ষার আদর্শ (১৯১৮), ঠাকুরমার চিঠি (১৯২৪), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবনপথে (১৯৩০) প্রভৃতি। কামিনী রায়ের কবিতায় গার্হস্থ্য বিষয়াবলিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনগঠনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাপ্রসূত পরামর্শ ও উপদেশ তিনি বিতরণ করতে চেয়েছেন কবিতায়। বাংলাসাহিত্যের নীতিকবিতার ধারায় কামিনী রায় হয়ে উঠেছেন অনিবার্য নাম। তাঁর প্রতিটি কবিতায় থাকে শিক্ষণীয় উপাদান। কিন্তু সেগুলো যুক্তি কিংবা গদ্যের শাসনে উপস্থাপন না করে কবিতার পেলব ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এর আবেদন তাই দীর্ঘস্থায়ী, এবং কখনো কখনো চিরস্থায়ী। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কবিতার মর্মবাণী বাঙালি মাত্রেরই অভিজ্ঞতার ফসল। পাছে লোকে কিছু বলার ভয়ে আমাদের সংকল্প স্থির থাকে না, সামনে অগ্রসর হতে পারি না, মহৎ উদ্দেশ্যেও একসঙ্গে মিলিত হতে পারি না, ভয়ের কবলে আমাদের সকল শক্তিরই মৃত্যু ঘটে। এই শাশ্বত সত্য তিনি উদ্ধার করেছেন। এর মর্মকথা হলো পাছে লোকে কিছু বলার ভয় এবং লজ্জা উপেক্ষা করতে পারলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভবপর। কবি চমৎকার ছন্দে ও অন্ত্যমিলে বলেছেন ‘করিতে পারি না কাজ সদা ভয়, সদা লাজ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,পাছে লোকে কিছু বলে’। [পাছে লোকে কিছু বলে।] মানুষকে মহৎ কর্মে উদ্বুদ্ধকরণের জন্যে এই কবিতাটি হতে পারে উৎকৃষ্ট টনিক। আজকে যারা উন্নয়নে ‘এওয়ারনেস বিল্ডিং’-এর জন্য প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মকা- পরিচালনা করেন, তাঁরা এই কবিতাটিকেও ব্যবহার করতে পারেন। এই কবিতায় ব্যবহৃত দুটি চরণ প্রবাদের মতো ব্যবহারযোগ্য। একটি ‘স্নেহের কথা প্রশমিতে পারে ব্যথা’। [পাছে লোকে কিছু বলে।] কী চমৎকার অনুভূতি! স্নেহময় একটি কথাই কারো মনের বেদনা ঘুচিয়ে দিতে পারে। স্নেহ এখানে আশ্রয়, অবলম্বন, সান্তনা, ক্ষতস্থানের মলম। একই কবিতায় কবি বলেছেন, ‘শক্তি মরে ভীতির কবলে’। কী শক্তিশালী উচ্চারণ ! মানুষকে ঘা মেরে জাগিয়ে তোলার মহামন্ত্র বিলিয়েছেন কবি কামিনী রায় এই কবিতার মাধ্যমে। এই কবিতায় কবির ছন্দোসাফল্যও প্রশংনীয়। প্রচলিত অক্ষরবৃত্তের ৮+৮+৮+৮ মাত্রার পরিবর্তে কবি ৮+৮+১০+৮ মাত্রার চাল গ্রহণ করেছেন। চার চরণের অনুচ্ছেদের তৃতীয় চরণে একবার মাত্র অপূর্ণ মাত্রা রেখে ভিন্ন রকম এক দোলা সৃষ্টি করেছেন। এই রকম মাত্রাবিন্যাস খুব বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আত্মশক্তি-উদ্বোধনের এই কবিতা সংশয়বাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানকে ঘোষণা করে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হলে সুখ পাওয়া যেতে পারে, এই দর্শনই এই কবিতায় প্রকাশিত। ‘সুখ’ কবিতাটি কামিনী রায়ের অনুপম সৃষ্টি। দীর্ঘকবিতায় সুখ ও দুঃখের প্রকৃতি অনুসন্ধান করেছেন। সংসারনাট্যে যে সুখ ও দুঃখের দুই অঙ্ক সমানভাবে অভিনীত হয়, কবি তা বলতে চেয়েছেন। তবে কবি আশাবাদী যে, সংসার কেবলি বিষাদময় নয়, সুখের অস্তিত্বও সেখানে বিরাজমান। প্রশ্নের ভাষায় কবির উপলব্ধি ‘ নাই কি রে সুখ ? নাই কি রে সুখ ? এ ধরা কি শুধু বিষাদময় যাতনে জ্বলিয়া, কাঁদিয়া মরিতে কেবলি কি নর জনম লয়’ ? [সুখ] কবি বলেছেন, সুখ এই সংসারে আছে। কিন্তু তাঁকে পেতে সংসারক্ষেত্রেও যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে যে জেতে, সে সুখ পায়। সংসারে সুখ পাওয়ার আরো কিছু সূত্র তিনি আবিষ্কার করেছেন। একটি সূত্র মতে, পরের কারণে নিজ স্বার্থ বিসর্জন তো বটেই, জীবন ও মন দান করলে সুখ পাওয়া যায় ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ-জীবন মন সকলি দাও তার মতো সুখ কোথাও কি আছে ? আপনার কথা ভুলিয়া যাও’। আরেকটি সূত্রে কবি বলেছেন যে, পরের কারণে যদি মৃত্যুও হয়, সেটিই সুখ। সুখ সুখ করে কাঁদলে কেবল হৃদয়ের ভার বৃদ্ধি পায়। তাই সুখের প্রত্যাশা না করে পরের মঙ্গলে জীবন উৎসর্গ করলে সুখ পাওয়া যায়’। পরের কারণে মরণেও সুখ ‘সুখ’, ‘সুখ’ করি কেদ না আর, যতই কাঁদিবে, ততই ভাবিবে, ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার। কবির জীবনোপলব্ধি এবং জীবনদর্শন ফুটে উঠেছে আরেকটি সূত্রে। ব্যাখ্যার আগে কবির বাণীময় চরণ দর্শন করা যেতে পারে ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। এটি এমন এক দর্শন যা কেবল মনোজগতের সম্পদ নয়। একে সমাজ-উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে। সমবায়ের মৌলিক ধারণার বীজও এর মধ্যে নিহিত রয়েছে।

কামিনী রায়ের সমকালীন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পল্লীউন্নয়নের যে মডেল তৈরি করেছেন, তাতে সমবায়ের রীতিপদ্ধতি ছিল, সমিতি-গঠনের নিয়ম ছিল, কমিউনিটি স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল, শালিস প্রথা ছিল, ঋণদান পদ্ধতি ছিল, ধর্মগোলা ছিল। রবীন্দ্রনাথের এই সমবায়ী কর্ম দর্শনের সঙ্গে কবি কামিনী রায়ের চিন্তাদর্শনের মিল ছিল। আমাদের পল্লীউন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের শ্লোগানেও ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ বাক্যবন্ধ ব্যবহৃত হয়। সারাদেশের সমবায় সমিতি পরিচালিত হয় এই শ্লোগানের মাধ্যমে। কামিনী রায় এক সমবায়ী সুখের মন্ত্র বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে প্রজাহিতৈষণা ভেবেছেন। আর আমাদের দেশের সেবাকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছুতে একই বাণীর ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ও কামিনী রায়ের স্বীকৃতি না থাকলেও সুখ-অন্বেষার এই পদ্ধতির প্রসার ঘটিয়েই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কাজ করে ব্যাঙ্কিং তথা অর্থনীতির সেক্টরে। কিন্তু ডক্টর ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন শান্তির জন্য। কামিনী রায় যাকে সুখ বলেছেন, তারই প্রতিশব্দ শান্তি। নোবেল কমিটি সেই শান্তির জন্যই নোবেল পুরস্কার দিল বাংলাদেশের ‘শান্তিকামী’ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে। বাঙালির শান্তিদর্শনের প্রথম সাহিত্যিক-প্রবক্তা ছিলেন কামিনী রায়, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কার্যক্ষেত্রে তৃতীয় মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূসের কর্মকান্ড বিতর্কিত হয়ে উঠলেও তাঁর সম্মান পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় দোষ নেই। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ বাক্য রচনার জন্যই কামিনী রায় নোবেল পুরস্কার অর্জনের যোগ্য ছিলেন, তাঁর স্বীকৃতি পাওয়া গেল ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। তবে নোবেল পাওয়া অনেক মানুষ ও তাঁর কাজ হারিয়ে গেছে, কিন্তু কামিনী রায় এখনও বেঁচে আছেন, এই তাঁর যোগ্য পুরস্কার। ‘অনুকারীর প্রতি’ নামের আরেকটি কবিতায় কামিনী রায়ের ভিন্ন জীবনদর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিনি প্রশ্ন করেছেন ‘পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মতো কেন বলিস ? পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো কেন চলিস ? ..... পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি আর কোথাও পাবি না রে’! [‘অনুকারীর প্রতি’] আমাদের নিজস্ব বা নিজত্ব রক্ষার কথা কবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই কবিতার মধ্যে আমরা কিছুটা বাউলদর্শনের প্রভাব লক্ষ করি। কিংবা বলা যেতে পারে কামিনী রায়ই হয়ে উঠেছেন সাধক বাউল। ‘আপন মাঝে ডুবে যা রে’ বলার মধ্য দিয়েই বাউলকবি কামিনীর চেহারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রযুগের এই শক্তিমান কবির দর্শন নিয়ে আরো ভাবনাচিন্তার সুযোগ রয়েছে। তাঁর কবিতায় নারী-পুরুষ সমতার ধারণারও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আজকে যারা নারীবাদী চিন্তা করছেন, তাঁদের অবশ্য মান্য হতে পারেন কামিনী রায়। যারা উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত, বিশেষত এনজিও করছেন, তারাও অবলম্বন করতে পারেন কামিনী রায়ের চিন্তাধারাকে। যাঁরা সমবায় নিয়ে ভাবছেন তাঁদেরও আদর্শ হতে পারে কামিনী রায়ের কবিতা।

কামিনী রায় নীতিবাদী কবি, শান্তিবাদী কবি, উন্নয়নবাদী কবি, সমবায়ী চিন্তার কবি, সার্বিক অর্থে জীবনবাদী কবি। তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা, সাম্যের কথা, সমবায়ের কথা। তাঁর কবিতার দর্শন বাঙালির শাশ্বত জীবনেরই দর্শন। তাঁর দেখার চোখ আলাদা বলেই আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন আলাদাভাবে। আমরা যারা দেখেও দেখতে পাই না, তাদের জন্য কামিনী রায়ের কবিতা এক আশ্চর্য দীপশিখা ! ১৮৮০ সালের ৩০শে জুন মাত্র ষোল বছর বয়সে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার ছয়মাস আগে লেখা তাঁর ‘সুখ’ কবিতার পূর্ণপাঠ এখানে উদ্ধার করা যায়। সুখ নাই কিরে সুখ ? নাই কিরে সুখ ?--- এ ধরা কি শুধু বিষাদময় ? যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে কেবলি কি নর জনম লয় ?--- কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা সৃজেন কি নরে এমন করে' ? মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে মানবজীবন অবনী 'পরে ? বল্ ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে,--- না,---না,---না,---মানবের তরে আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর, না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে। কার্যক্ষেত্র ওই প্রশস্ত সমর-অঙ্গন সংসার এই, যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ; যে জিনিবে সুখ লভিবে সেই। পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে ? আপনার কথা ভুলিয়া যাও। পরের কারণে মরণের সুখ ; "সুখ" "সুখ" করি কেঁদনা আর, যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে, ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার। গেছে যাক ভেঙ্গে সুখের স্বপন স্বপন অমন ভেঙ্গেই থাকে, গেছে যাক্ নিবে আলেয়ার আলো গৃহে এস আর ঘুর 'না পাকে। যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা ? বিষাদ এতই কিসের তরে ? যদিই বা থাকে, যখন তখন কি কাজ জানায়ে জগৎ ভ'রে ? লুকান বিষাদ আঁধার আমায় মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত, সারাটি রজনী নীরবে নীরবে ঢালে সুমধুর আলোক কত ! লুকান বিষাদ মানব-হৃদয়ে গম্ভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়, দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চীত্কার, আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙ্গে না তায়। বিষাদ---বিষাদ---বিষাদ বলিয়ে কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে'? মানবের মন এত কি অসার? এতই সহজে নুইয়া পড়ে ? সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে পারনা মুছিতে নয়ন-ধার ? পরহিত-ব্রতে পারনা রাখিতে চাপিয়া আপন বিষাদ-ভার ? আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। [আলো ও ছায়া, ১৮৮৯]

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক, বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত