এসো পা বাড়াই (৩৫ তম পর্ব)

প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৩:২১

"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"

LEAN IN                                                                 এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD         নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG                           অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি

বর্তমান নিয়োগকর্তাকে অন্য প্রতিষ্ঠানের বেতনের উদাহরণ দেয়া একটা প্রচলিত পন্থা, কিন্তু তা নারীর চেয়ে পুরুষের ক্ষেত্রে সহজে কাজ করে। নিজেদের অর্জনে মনোনিবেশ করা, পুরুষের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, যেখানে নারীদের থেকে আশা করা হয় আনুগত্য। এছাড়া শুধুমাত্র চমৎকার হওয়াই বিজয়ীর কৌশল নয়। চমৎকার হওয়া, এই বার্তা দেয় যে অন্যের কাছে পছন্দনীয় হওয়ার জন্য নারীরা তার বেতনের ক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকারে ইচ্ছুক। এই কারণেই নারীদের দরকার চমৎকারের সাথে চাপ প্রয়োগের জেদটাও যোগ করা। এই রীতিকে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি (president of the university of Michigan), মেরি সু কোলম্যান (Mary Sue Coleman) “নিরলসভাবে মনোরম (relentlessly pleasant)” বলে অভিহিত করেছেন। এই পদ্ধতিতে প্রয়োজন ঘন ঘন মুখের হাসি, কৃতজ্ঞতা এবং উদ্বেগ প্রকাশ, সর্বসাধারণের স্বার্থকে আমন্ত্রণ জানানো, বৃহত্তর লক্ষ্যে জোর দেয়া এবং সমালোচনামূলক ভঙ্গীর বদলে, দরকষাকষিকে এমনভাবে প্রকাশ করা যেন কোন সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। বেশিরভাগ দরকষাকষির সঙ্গে জড়িয়ে আছে টানা ধারাবাহিক পদক্ষেপ, তাই নারীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখতে হবে- এবং হাসতে হবে।

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নারীরা, পুরুষ যে পরিমাণ দরকষাকষি করে সে পরিমাণ দরকষাকষি করে না। এ যেন উঁচু হিল পরে পেছন ফিরে একটি মাইন ফিল্ড পার হওয়ার চেষ্টা। তাহলে আমাদের কি করা উচিত? আমাদের কি মূল্য পরিশোধ করা উচিত অন্যের তৈরী এই নিয়মের জন্য? আমাদের কি উচিত একটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রকাশ ভঙ্গীর পথ আবিস্কার করা, যেভাবে খুব বেশি চমৎকার হবো না, প্রদর্শিত হবে সঠিক মাপের আনুগত্যতা এবং ব্যবহার করবো 'আমরা' ভাষা? পক্ষপাতদুষ্ট নিয়ম এবং প্রত্যাশা মেনে নিয়ে নারীকে পৃথিবী বদলানোর উপদেশ দেয়ার, এই প্যারাডক্স আমি বুঝি। আমি জানি এটাই সঠিক উত্তর নয় কিন্তু ঐচ্ছিক সমাধানে পৌঁছানোর এটা একটা উপায়। এটাও সত্য যা যেকোন ভালো আলোচনাকারী জানে যে, অন্য পক্ষ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা থাকলে তা উচ্চতর ফলাফল বয়ে আনে। তাই অন্ততপক্ষে নারীরা দরকষাকষি শুরু করতে পারে এই জ্ঞান নিয়ে যে তারা সর্বসাধারণের ভালোর জন্য উদ্বিগ্ন, যদিও তারা নিজেদের জন্য দরকষাকষি করবে, নিজেদের অবস্থান শক্ত করবে।

অধিকন্তু, সামষ্টিক প্রচেষ্টা বিষয়টারই বিপুল সুবিধা রয়েছে। সংজ্ঞানুসারে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানই একসঙ্গে কাজ করার জন্য অনেকগুলো মানুষ নিয়ে গঠিত হয়। পুরো দলের প্রতি গুরুত্ব দিলে উন্নততর ফলাফলের দিকে যায়, এই সহজ কারণে যে, একক ব্যক্তির চেয়ে যথাযথ কার্যকারী দল বেশি শক্তিশালী। যারা একত্রে কাজ করতে পারে না তাদের চেয়ে, একসঙ্গে কাজ করে যে দল, তারা অনেক ভালো করে। সাফল্য অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়া গেলে তা অনেক ভালো লাগে। তাই সম্ভবত, আরও বেশি নারী শীর্ষ পদ পেলে একটি ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে যে, আমাদের নেত্রীরা অনেক বেশি অন্যের ভালো করার প্রতি প্রশিক্ষিত থাকবেন। অবশ্যই, আমার আশা এই যে, প্রাচীন এসব নিয়মের জন্য চিরকাল আমাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে না।

আমাদের এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ২০১১ সালের নভেম্বরে, সান ফ্রান্সিসকো (San Francisco) পত্রিকা সিলিকন ভ্যালির (Silicon Valley) নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি গল্প প্রকাশ করেছিল, যেখানে ছবি আঁকা হয়েছিল, পুরুষের শরীরের উপর নারীর মাথা বসিয়ে দিয়ে। সফল উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে একমাত্র এই দেহ গড়নই তারা কল্পনা করতে পারে যারা টাই অথবা হুডি পরে থাকে। আমাদের সমাজে সফল নারীদের একটি দৃঢ় চিত্র খোঁজা দরকার যা প্রথমত, কোন পুরুষের নয়, দ্বিতীয়ত, কানে ফোন ধরে রাখা কান্নারত বাচ্চা কোলে কোন সাদা নারীর নয়। বস্তুত, “ব্রিফকেস হাতে খারাপ মা” এর ছবি এত বেশি প্রচলিত যে লেখিকা জেসিকা ভ্যালেন্টি (Jessica Valenti) এক মজার এবং বিদ্রূপাত্মক ব্লগ এ তা সংগ্রহ করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন, “হীনচেতা নারীবাদী মায়ের কোলে বিমর্ষ সাদা শিশু” (Sad White Babies with Mean Feminist Mommies)।

(চলবে...)