ফ্রান্সে বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন

প্রকাশ | ০২ নভেম্বর ২০১৭, ১০:১৫

শুভাশিষ রায় শুভ, ফ্রান্স

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫০ বছর পদার্পণ উপলক্ষে উদীচী ফ্রান্স সংসদের উদ্যোগে ফ্রান্সের মাটিতে উদ্বোধন হলো বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের। ফ্রান্সে বেড়ে উঠা পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এই কেন্দ্র তার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। গত ২৯ অক্টোবর ২০১৭ রবিবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় শুরু হয় এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. অনাদি ভট্টাচার্য্য, ইনালকো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. ফিলিপ বেনুয়া, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আমিরুল আরহাম, ফ্রান্সস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসের কমার্স কাউন্সিলর ফিরোজ উদ্দীন, প্রগতিশীল সমাজ কর্মী ও শিক্ষক হাসনাত জাহান এবং লা মেজ দো লা ছাজেছ থেকে ম্যাডাম মারি থেরেজ।
উদীচী ফ্রান্স সংসদের সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ আলী দুলাল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন উদীচী ফ্রান্স সংসদের সভাপতি কিরন্ময় মণ্ডল।

সমাজকর্মী হাসনাত জাহান তাঁর আলোচনায় বলেন, ফ্রান্স কমিউনিটি অনেক বড় হচ্ছে, এই কমিউনিটিতে প্রতিটি এলাকায় এরকম একটি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা জরুরী।

চলচ্চিত্র নির্মাতা আমিরুল আরহাম বলেন, এটা অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ যে এরকম একটা প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে উঠছে। এই কমিউনিটিতে আমদের জনসংখ্যা অনেক। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানে যারা বড় হচ্ছে তাদের বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষাকে সঠিকভাবে জানানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। উদীচী ফ্রান্স সংসদকে ধন্যবাদ জানাই এরকম একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য।

অধ্যাপক ফিলিপ বেনুয়া বলেন, আপনারা অনেকদিন ধরে লড়াই করছেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য। আজকের সমাজে ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য লড়াই করার অর্থ হচ্ছে তাঁর নিজস্ব অস্তিত্বের জন্য কাজ করা।

তিনি বলেন, যারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কর্মী তাঁরা ধর্ম নিরপেক্ষতার কর্মী, তাঁরা যুদ্ধ করছে মানবতার ধর্মকে বাঁচানোর, তাঁরা কোনকিছু বিচার করার বা প্রচার করার সময় ধর্মকে প্রচার না করে মানুষ ধর্মকে প্রচার করেন।

বিজ্ঞানী অনাদি ভট্টাচার্য্য বলেন, আমি খুবি আনন্দিত যে উদীচী এমন একটা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সময় তিনি ভাষা কেন্দ্রের জন্য সর্বাত্মক সহযোগীতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।

বাংলাদেশ দুতাবাসের কমার্স কাউন্সিলর মোঃ ফিরোজ উদ্দিন বলেন, ফ্রান্সে বাঙালি এবং বাংলা সংস্কৃতির মূল শেকড় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সকল বাঙালির এই সংগঠনের সাথে একাত্ম হওয়া উচিৎ। সংস্কৃতি শুধুই ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা অনেক বড় ব্যাপার, এটা একটা সমন্বিত আচরণের ব্যাপার। একটা জাতি কতটা উন্নত বোঝা যায় তাঁর সংস্কৃতি কতটা উন্নত। উদীচী ফ্রান্স সংসদ তাঁদের বাংলা ভাষা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিবেন এই প্রত্যাশা করি।

উদীচী ফ্রান্স সংসদের সভাপতি কিরন্ময় মণ্ডল তাঁর আলোচনার শুরুতে শোক প্রকাশ করেন অকাল প্রয়াত প্যারিস প্রবাসী চিত্রশিল্পী কাজী ইসমাইল মুহিত (জ্যোতি) স্মরণে। তিনি ফ্রান্স উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে তাঁর অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। তিনি আরও শোক প্রকাশ করেন বাংলাদেশের চিকিৎসক এর অবহেলায় প্রবাসে বাংলা প্রত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক অপু আলম এর ছোট ছেলে প্রিতম এর অকাল মৃতুতে এবং বাংলাদেশের পরম বন্ধু ফাদার রিগান এর মৃত্যুতে। 

সভাপতি তাঁর বক্তব্যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন, সিরিয়ায় অমানবিক নির্যাতনে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

তিনি বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং প্যারিসে বসবাসরত অভিভাবকদের প্রতি আহবান জানান তাঁদের সন্তানদের এই কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করে বাঙালি সংস্কৃতিকে জানতে সহযোগীতা করার জন্য।

আলোচনা সভা শেষে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে উদীচী পরিবারের শিশু-কিশোর সহ উদীচীর শিল্পীদের সমন্বয়ে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। এ সময় উদীচীর কিশোর শিল্পী অবিতথ, বিলাস, রুদ্র ও মনিষা মিলে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলেন। এর পরপরই শিশু শিল্পী রোদশি, অমিত, সীম, আরশি, রশ্মি, রৌদ্র, জয়ীতা, আনুষ্কা, অন্দ্রেয়া, অর্ক ১, অরপা, অর্ক ২, উৎসা, ঋতু, শ্রেয়া, নেহা, সকাল, অবন্তিকা ও নায়েল গান, নাচ ও কবিতা দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে।

উদীচী ফ্রান্স সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুস্মিতা বড়ুয়ার সঞ্চালনায় শিশুদের অনুষ্ঠানের পরপরই অনুষ্ঠিত হয় উদীচীর নিয়মিত শিল্পীদের পরিবেশনা। অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন রোজী মজুমদার, সাগর বড়ুয়া, সান্তনু দেবী ও রুবেল চন্দ্র দাশ। দ্বৈত কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করেন শম্পা বরুয়া ও শর্মিষ্ঠা বরুয়া। এছাড়া সমবেত কণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশনায় আরও যারা ছিলেন কিরন্ময় মণ্ডল, প্রদীপ বড়ুয়া টিপু, দীপক গোমেজ, সুস্মিতা বড়ুয়া, ছুটি বিশ্বাস, সামসাত জাহান মনিতু, টুইংকেল বিশ্বাস, বৃষ্টি মণ্ডল, এলান খান চৌধুরী, তপন দাস, রাজু আহমেদ ও রূপা আক্তার। 

উদীচীর দলীয় সংগীত ‘আরশির সামনে’ গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্য শিল্পী সুবর্না তালুকদার ও শরিফুল ইসলাম। যন্ত্রাংশে সহযোগীতা করেন শাপলু বড়ুয়া, অনুভব চট্টপাধ্যায়।