অণুগল্প

চোরকাঁটা

প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ০২:০৪

ফিরোজ আহমেদ

বাবা অসহায়ের মত পাশে বসে। চোখে বোকা দৃষ্টি। অঝোরে কাঁদছে মেয়েটা...

সময়টা ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী। তখন সবাই পালিয়েছে রাষ্ট্র এবং সমাজ ছেড়ে। অফিসগুলো শুধু সময়মতো দরজা খোলে, কাজ থাকুক না থাকুক, সমাপনী পর্যন্ত লোকজন বসে থাকে, তারপর ঘরে যেয়ে টিভি চ্যানেলে খবর দেখে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার নতুন যোগদান করেছে। পুরো উপজেলা তাকেই সামলাতে হয়। রাজনীতি এখন নিষিদ্ধ গন্ধম। সবাই পলাতক থাকায় উপজেলার প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে ইউএনও সাহেব মহাবিপাকে। সবাই তার কাছে আসে। নানান প্রতিকার চায়। সে সাধ্যমত সালিশ করে সিদ্ধান্ত দেয়। কঠোর জরুরি আইনের কারণে সবাই মানতে বাধ্য হয় সে আদেশ। ইতোমধ্যে চারিদিকে চাউর হয়ে গেছে ইউএনও সাহেবের সালিশের কথা। প্রতিদিন নালিশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। 

“আমার মায়ের সম্পত্তির ভাগ দেয় নি মামারা”;
“আমার মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশ চলে গেছে, এখন সে বিদেশ থেকেই তালাক পাঠিয়েছে, মেয়েকে আর রাখবে না”;
“স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ জোর করে দখল করে রেখেছে জয়নাল মাস্টার। আপনি সুরাহা করে দেন”
এরকম হাজারটা নালিশ...

সেদিন অপরাহ্ণ। ইউএনও সাহেব যথারীতি বসে আছেন দপ্তরে। এমন সময় নারীকণ্ঠের আওয়াজ-
-“স্যার আসব?”

মুখ তুলে দেখা গেল একজন অল্পবয়ষ্ক মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। তার পিছনে ভীরু চেহারার মধ্যবয়স্ক একজন লোক। দুজনেই অনুমতি পেয়ে ভিতরে ঢুকে। দাঁড়িয়ে থাকে। বসতে বললে বসে। আগমনের হেতু জানতে চাইলে নিশ্চুপ থাকে দুজনই। মেয়েটা কাঁদতে থাকে। ইউএনও সহানুভূতি দেখিয়ে সমস্যা জানতে চাইলে বাড়তে থাকে ক্রন্দন। শেষে ধমক দিলে কান্না থামে। জানা গেল তারা পিতা-কন্যা। এক অদ্ভুত আরজি নিয়ে এসেছে। মেয়েটির সঙ্গে এক তরুণের প্রণয় ছিল। বেশ গভীর এবং কয়েক বছরের পুরোনো। মেয়েটি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফলের অপেক্ষায় আছে। সে সকল নিয়ে বসেছিল, ছেলেটির সঙ্গে সংসার হবে। ফুটফুটে সন্তান আসবে ঘর আলো করে। দুজনে পাড়ি দেবে অমরাবতীর মহাসমুদ্র...

কিন্তু, বিধি বাম। তরুণ রোমিও মন পরিবর্তন করেছে। সে আর এই মেয়েটিকে চায় না। ইউএনও সাহেবকে এখন দায়িত্ব নিতে হবে। তরুণের মন ফিরিয়ে দিতে হবে। অদ্ভুত আর্জি শুনে ইউএনও সাহেব বিপর্যস্ত, হতাশ এবং কিছুটা ক্ষিপ্ত।

“প্রেম করেছো এক লাফাঙ্গার সাথে। তুমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছো আর ছেলে এখন পযর্ন্ত দশম শ্রেণির চৌকাঠ ডিঙাতে পারেনি। সেই ছেলে এখন তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই কুলাঙ্গারের জন্য আবার তোমার চোখে পানি ঝরে!”

রাগে ও অসহায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইউএনও। প্রতারক রোমিওর বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে সে কী ব্যবস্থা নেবে! মেয়েটি চায় সংসার। আর এই ধরণের ছেলের সাথে সেই সংসারের ভবিষ্যত কী? তিনি মেয়েটির বাবার উপর রাগ ঝাড়েন-

–“আপনি কী করেছেন এতদিন? খেয়াল রাখতে পারেন নি? মেয়ে কার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়? জানেন না মেয়েদের মানুষ করার কী জ্বালা?”
–“কী করবো স্যার! মা মরা মেয়ে। একজনকে পছন্দ করে জানতাম। ওদের মধ্যে কোন খারাপ কিছু তো চোখে পড়েনি। মেয়ে পছন্দ করেছে। আমি মানা করবো কোন মুখে?”

ইউএনও অবাক হয়ে চেয়ে থাকে পাড়াগাঁয়ের এই আধুনিক পিতার দিকে। প্রেম যে সমাজে পাপের সমতুল্য, সেই সমাজের অজ অঞ্চলের অর্ধশিক্ষিত এক লোক বলে কীনা- প্রেমে তার মানা নেই!
ইউএনও বোঝানোর চেষ্টা করে মেয়েটিকে।

–“এ ছেলে তোমাকে ভালবাসে না। কোনদিন ভালোবাসেনি। ক্ষণিক প্রেমিক এরা। এদের বিশ্বাস নেই। সংসার করার মানসিকতা এদের নেই...”
–“ও না ভালবাসুক, আমি তো ওকে ভালোবাসি”- মেয়েটি ইউএনওকে থামিয়ে দেয়। 

ইউএনও অসহায় চেয়ে থাকে। মূঢ় মেয়েটির মন থেকে ভালোবাসার চোরকাঁটা তুলবে কেমন করে? সে কী ব্যবস্থা নেবে? সে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করে-

–“প্রচলিত আইনে কোন ব্যবস্থা নেয়ার উপায় নেই। প্রেম যে কেউ করতে পারে। এর মধ্যে কুৎসিত কিছু না থাকলে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। জোর করে, সমাজের পাঁচজনকে ডেকে ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে বটে, কিন্তু সে বিয়ে আদৌ সুখের হবে কি?”

মেয়েটি নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে বসে থাকে। পিতাও একইভাবে ইউএনওর কথার পুনরাবৃত্তি করে গুণগুণ করে। দুজনেই শেষ ভরসা বিবেচনা করে এখানে এসেছিল। কিন্তু বুঝতে পারে আসলেই কোন আশা নাই। শেষে ইউএনও বলে- “আপনার তাহলে আসুন”।

নিশ্চুপ হয়ে যায় দুজনই। পিতা অসহায় বোকা চেহারা নিয়ে বসে থাকে। মেয়েটির মাথা নিচু, যেন সীতা খুঁজছে মাটিতে সেই পুরানো মহাফাটল। যেন নীরবে বলছে ধরণী দ্বিধা হও। মেয়েটির চোখ থেকে ঝরতে থাকে অঝোর ধারা...

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত