ছোটগল্প

শুভঙ্করের ফাঁকি

প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ০০:২৫

তাহমিনা শাম্মী

তিন বছর এক সাথে থাকার পর অবশেষে আমার জন্মদিনের দিন শুভঙ্কর আমাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। আজকের পুরো প্রোগ্রামের প্ল্যান সে একাই করেছে, বন্ধুদের নিমন্ত্রণ দেওয়া থেকে শুরু করে ক্যটারিং ও ঘর সাজানো, কোথাও কমতি রাখেনি। সে অবশ্য আমার কোনো ইচ্ছা বা চাওয়া কখনোই অপূর্ণ রাখে না। আজকের এতো বড় সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজনে আমিও অবাক না হয়ে পারিনি। জন্মদিনের কেকের মধ্যে লুকানো ছিল হীরের আংটিটা। ও কেকটা কেটে মুখে তুলে দিলে প্রথম বাইটেই বুঝতে পারলাম কিছু একটা আছে। মুখ থেকে আংটিটা বের করতে করতেই সে হাঁটু গেড়ে বসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল “Will You Marry Me?”

আমাদের সাড়ে তিন মাসের অনাগত সন্তান পৃথিবী দেখার অপেক্ষায়। আমরা কখনোই বিয়ে করে নিজেদের ভালোবাসাকে কোনো নিয়মে বাঁধতে চাইনি। কিন্তু এ দেশের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সামাজিকতাটাকেও এখন আর উপেক্ষা করতে পারছি না। তাই এই সিদ্ধান্ত। আমারা অবশ্য কখনোই সমাজকে অবজ্ঞাও করিনি, শুধুমাত্র কিছু অন্ধ বিশ্বাস, রীতিনীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমাদের এই পথ চলা সহজ ছিলো না, আমাদের বিশ্বাসের জায়গা ছিলো তেমনি ঠুনকো নয়।

সামাজিক বৈষম্যগুলো আমাকে বরাবরই খুব পীড়া দেয়, তা লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ বা অর্থনৈতিক, যেটাই হোক না কেনো। শুধু আমি নয় আমরা দুজনেই এর বিপক্ষে। আমরা ব্লগে লেখি, যে কোনো বৈষম্যমূলক আন্দোলনে হাতে হাত ধরে রাজপথে নামতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না।

তবে বিয়ে করতে না চাওয়ার পেছনে আমাদের যুক্তিটা ছিলো অন্যরকম, দুটো মানুষ যখন ভালোবেসে কাছাকাছি আসে তখনই তাদের আত্মার মিলন ও বিয়ে দুটোই হয়ে যায়। বিয়ে তো সামাজিক নিয়ম মাত্র, যা একেক ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের কাছে একেক রকম। তাই নিজেদের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে কখনোই কোনো ধরনের নিয়মে বাঁধতে চাইনি, এখনো যে খুব চাই তাও নয়। আজ ও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় খুব একটা খুশি না হলেও হাত বাড়ানোর সাথেসাথেই ওকে জড়িয়ে ধরেছি। সিদ্ধান্তটা ওর একার নয়, আমাদের সব সিদ্ধান্তই আমাদের দুজনার।

পার্টি শেষে সবাই চলে গেলেও ওর বন্ধু কনক আরো কিছুটা সময় রয়ে গেলো। আমরা তিনজন মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। ফিরে যাওয়ার সময় কনক পিছু ফিরে শুভঙ্করের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো, বাই দ্যা ওয়ে, তোদের বাচ্চার পদবী কী হবে?

আমি শুভঙ্করের উত্তর জানতাম, ও নিশ্চয়ই বলবে পদবী মানুষকে বড় করে না, হয় অহংকারী না হয় হীনমন্য করে। আমার সন্তান মানুষ হবে, ও নিজের পরিচয় নিজেই গড়বে, নাম অবশ্য একটা থাকবে।

কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে সে উত্তর দিলো, “যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, তাই বাবার পরিচয়টাইতো মুখ্য, তাই না?”

লেখক: তরুণ কবি ও বাচিকশিল্পী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত