ঋতুস্রাব নিয়ে প্রথা ভাঙার লড়াইয়ে কৃষ্ণমায়া

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:১১

কৃষ্ণামায়া

১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নারীদের ঋতুস্রাবের সময় তাদেরকে বাড়ির বাইরে রাখার একটি প্রাচীন হিন্দু রীতি নেপালে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এই রীতিটি ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ করা হলেও দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় এলকায় এখনো এর চল আছে।

বিবিসি নেপালি সার্ভিসের রিপোর্টার কৃষ্ণামায়া উপাধ্যায় বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে তিনি এই সনাতন পদ্ধতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, যা সেখানে ছাউপাডি নামে পরিচিত:

১৩ বছর বয়সে আমার ঋতুস্রাব শুরু হয়। আমার মা, বোন এবং ভাবি তাদের ঋতুস্রাবের সময়টাতে বাড়ির বাইরে একটি মাটির ঘরে থাকতো, আমিও তাদের মত সেখানেই থাকা শুরু করি। কী হবে তা ভেবে আমি সবসময় ভয় পেতাম। পোকামাকড় এবং বন্যপ্রাণীর ভয়ে আমার সময় কাটতো। আমাকে বলা হয়েছিল এই সময়টাতে বই স্পর্শ করা পাপ। তাই আমি ঋতুস্রাবের তিন দিনে স্কুলেও যেতাম না। কেন আমি বই স্পর্শ করতে পারবো না সেটাও আমি ভাবতাম। স্কুল খুব মিস করতাম। শুধু আমি না, গ্রামে আমার মত অনেক মেয়েরও একই সমস্যা ছিল।

এমনকি আজকের দিনেও মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় মেয়েদের সাত দিন বাড়ির উঠানে যেতে দেয়া হয় না এবং দুধ, মাখন বা দইসহ যেকোন ধরণের দুগ্ধজাত খাদ্য খেতে দেয়া হয় না। ঋতুস্রাবের সময় এমনকি হাতেও কোন খাবার দেয়া হয় না, খাবার ছুড়ে মারা হয়।

কলেজে পড়ার জন্য কুটারি গ্রাম থেকে যখন আমি জুমলা জেলার রাজধানীয় খালাঙ্গাতে যাই, তখনো আমাকে একই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। একটি রুম ভাড়া নেয়ার জন্য এক বাসায় গেলে বাসার মালিক আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমার ঋতুস্রাব হচ্ছে কিনা। আমি যখন সত্যটা বলি, তখন আমাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কি করবো সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাসা ভাড়া না পেলে আমার পড়ালেখাও আর হবে না। শেষপর্যন্ত আমি একটা বাসা পাই। তবে বাসার মালিক শুধুমাত্র নীচতলায় ভাড়া দিতে রাজী হন। আমি তাতেই রাজী হই।

কিন্তু তারপরও সমস্যা ছিল। ঋতুস্রাবের সময় আমার পানির কলে হাত দেয়া নিষেধ ছিল, অন্য কেউ এসে আমাকে পানি দিয়ে যেত। আমি পড়েছিলাম যে এই সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, তাই আমি বাড়ির ভেতরের টয়লেট ব্যবহার করতাম। যদিও বাড়িওয়ালা বলেছিল আমাকে বাইরের টয়লেট ব্যবহার করতে।

খালাঙ্গাতে এক মাস কাটানোর পর আমি রেডিওতে কাজ করা শুরু করি। ঋতুস্রাব নিয়ে আমি আরো পড়াশোনা করি। যখন আমার বাড়িওয়ালা আমাকে বললো যে আমার মাসিকের কারণে তার সমস্যা হচ্ছে, তখন আমি বাড়ি ছেড়ে দিই। মেয়েদের এই কারণে শুধুমাত্র নীচতলায় ভাড়া দেয়া হয়। এসব বিশ্বাস শিক্ষিত মানুষের মাঝেও আছে। ছয় বছর যাবত আমি এখন রেডিওতে কাজ করছি। এখনো ঋতুস্রাবের সময় আমি বাসাতেই থাকি।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়ে ওঠা সামাজিক ব্যাধির চিকিৎসা শুধুমাত্র একজন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সমাজ যদি গ্রহণ না করে তাহলে পরিবর্তন সম্ভব নয়।

এখন আমি যখন গ্রামে যাই, তখন ঋতুস্রাবের সময়টা আমি আমার ঘরের ভেতরেই থাকি। রান্নাঘর বা প্রার্থনাকক্ষে আমি ঢুকি না। পরিবারের কাছে অনেকবার প্রতিবাদ জানানোর পর আমি এখন ঘরে থাকতে পারি, বাইরের মাটির ঘরে আর যেতে হয় না। আশা করি একদিন ছাউপাডি প্রথার অবসান ঘটবে, যেমনটা ঘটেছে সতীদাহ প্রথার।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত