উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক (প্রথম অধ্যায়: সনাতন মূল্যবোধ)

প্রকাশ | ১৮ মে ২০১৭, ০২:৪৯

উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক, বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তার গবেষণার আলোকে লেখা। 

পড়ে শেষ করলাম বইটি, পড়তে যেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েছি, নিতে হয়েছে। আমাকে ভাবিয়েছে বইটি, তথ্য উপাত্ত অবাক করেছে, কখনও কষ্ট পেয়েছি, গুমরে কান্না নিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। নিজের অজান্তেই করুণাও হয়েছে এই সময়ের কিছু নারী জীবন দেখে। সেই বৈরী সময়ের কতোটা পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা যদি তা উপলব্ধি করতো তাহলে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ যেমন জীবনধারা বেঁছে নিয়েছে তা ভাবাতো, নিশ্চয়ই ভাবাতো!!! 

এবং বলে নিতে চাই, আমি নিতান্তই একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এটি পড়তে যেয়ে যা আমাকে ভাবিয়েছে এবং মনে হয়েছে আরো আলোচনার দাবী রাখে সেই হিসেবেই পুরো বইটি’র একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।  

তেরটি ছোট অধ্যায়। লেখক এই বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ করছেন, উনিশ শতকের শুরুতে নারীপুরুষ সম্পর্কের যে চিত্র পাই তা প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সমাজের মতোই ছিল। 

নারীপুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে সনাতন মূল্যবোধ তথা চিরায়ত বাংলার পারিবারিক জীবনবোধ কেমন ছিল তা মূলত জানা যায় ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে। 

মধ্যযুগের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরো জানা যায় প্রধানত সাহিত্য ও নীতিশাস্ত্র থেকে এবং বিদেশি পরিব্রাজকদের বিবরণে। তবে এ সকল গ্রন্থই অবশ্য সংকলিত বা লিখিত হয়েছিল পুরুষের দ্বারা, সুতরাং তাতে মূলত ধরা পড়েছে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি। 

উনিশ শতকে বাংলার পারিবারিক বিবর্তনের ধারা তুলে ধরা হয়েছে পারিবারিক কাঠামোর এবং এ সংশ্লিষ্ট আদর্শিক দিক যা পরিবারকে পরিচালিত করে অর্থাৎ পিতৃতন্ত্র। আর পরিবারের মুল ভিত্তি হলো বিয়ে, উঠে এসেছে বিয়ের সকল আচার-অনুষ্ঠান এবং এগুলোর মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে নারীপুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক। 

১.

জানা যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে উনিশ শতকের শুরুতে এবং সাম্প্রতিককালে বাংলায় যে পরিবার তার মধ্যে একটি বন্ধন আছে। একটি অখন্ড হিন্দু পরিবার শুধু সম্পত্তির হিসেবেই যৌথ ছিল না, ছিল খাওয়া দাওয়া ও অভিবাবকত্বের দিক থেকেও। সাধারণত পিতা পরিবার প্রধান থেকে সমস্ত ব্যায়ভার করে নেতৃত্ব দিতেন, মাতা তাঁর স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের সেবা করতেন। 

পিতৃতান্ত্রিক যৌথ পরিবার প্রথা দীর্ঘকাল কঠোর লিঙ্গবৈষম্য ব্যাবস্থার মাধ্যমে গড়ে উঠে। ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে নারীর সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরন দৈনন্দিন কর্মবিভাজন যার বৈশিষ্ট্য। পরিবারে পুত্র ও কন্যার ভিন্ন ভূমিকা, অবস্থান, ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করার শিক্ষা দেয়া হতো। পুত্রসন্তানকে সেই পরিবারের স্থায়ী সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষিত করে তোলা হতো। অন্যদিকে কন্যাসন্তাকে সেই পরিবারের স্থায়ী সদস্য হিসেবে দেখা হতো!

যৌথ, বিস্তৃতি বা একক ধরনের পরিবারে নারীর বিভিন্ন প্রকার স্থান ও ক্ষমতা নির্ধারিত থাকলেও স্বামীর কর্তৃত্ব ও জ্যেষ্ঠতা কখনও লঙ্ঘিত হতো না। সনাতন পরিবারে বধূর ভূমিকা কঠোরভাবে শাশুড়ির কর্তৃত্ব, তত্ত্বাবধান ও নির্দেশের অধীন থাকতো। 

এই বিষয়ে লেখক অপরাপর আলোচক, গবেষক এবং ধর্মগ্রন্থের মত তুলে এনেছেন। সবই চমকে যাওয়ার মতন। ‘প্রাচীন বাংলার পিতৃশাসিত সমাজ পুরুষের সমান সুযোগ নারীকে বঞ্চিত করেছিল। ধর্মশাস্ত্রকারদের বিধান-অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে খেতো না। তবে রাজকীয় ও বিত্তবান পরিবারে কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী বাজি ধরে পাশা খেলতো। 

সেই সময় চাপিয়ে দেয়া নানান শৃঙ্খলায় নারীর যে রূপ উঠে আসে তা মর্যাদাহীন। নারীকে একজন পৃথক ও একক ব্যাক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো না এবং জীবনের কোন ক্ষেত্রেই সে স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারতো না। 

উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকেও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন প্রেক্ষিতে পরিবারের রূপ ও কর্মকান্ডে প্রভাব রেখেছে, একই সময়ে বিভিন্ন ধরণের পরিবার সহাবস্থান করেছে।  
এই অধ্যায়টিতে, একান্নবর্তী পরিবারে বা যৌথ পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনে অসুখী পারিবারিক জীবনের চিত্রও উঠে এসেছে। পরিবারে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতা কতোটা লঙ্ঘিত হতো, তা উল্লেখ করা হয়েছে কিছু সাহিত্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে। উল্লেখ করা হয়েছে ‘বিশ শতকের সাহিত্যেও বিশেষ করে শরতচন্দ্রের উপন্যাসে এবং রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’’ এবং ‘হৈমন্তী’’ গল্পের কথা’। 

বিশেষ আরেকটি তথ্য হচ্ছে, উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত শিশু মৃত্যুহার খুব বেশি থাকায় পরিবারের আকার খুব বড় হতোনা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের উদাহরণটি এর বাইরের।

১৮১৭, লোকগণনায় মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রথমে জানা যায়। মুসলমান সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের কোন ধর্মীয় অনুশাসন নেই, হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের প্রভাব থাকলেও মুসলমানেরা তা সর্বাংশে গ্রহণ করেনি। ফলে সংখ্যাধিক্য মুসলমান পরিবারগুলোয় পরিবর্তন দেখা যায়। 

২.

ঘুরে ফিরে তা উঠে আসে, পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে পুরুষের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। অন্তঃপুরবাসিনীদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মূল্য সেখানে ছিল না। পরিবারে স্ত্রীর স্থান ছিল স্বামীর অনেক নিচে। পন্ডিতেরা স্বীকার করেন যে পরিবারের ক্ষমতার বিন্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে যে পিতৃতন্ত্র, তার মূল কথা, পরিবারে এবং মানবজীবনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সকল ক্ষেত্রে পুরুষ প্রবল প্রতাপে আধিপত্য করবে; কিন্তু নারী থাকবে ক্ষমতাহীন এবং বাস করবে লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্তঃপুরে।

পিতৃতন্ত্র নারীকে দুর্বল, বুদ্ধিহীন, মানসিক ভারসাম্যহীন, ভীতু, হঠকারী ও আবেগপ্রবণ চিত্রিত করে। অপরপক্ষে, পুরুষকে চিহ্নিত করে সবলদেহী, প্রত্যয়ী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হিসেবে। বিভেদাত্মক গুণ ও স্বভাব আরোপ করে পিতৃতন্ত্র বিধান দেয় যে, পুরুষের আশ্রয় ও তদারকি ছাড়া নারী বাঁচতে পারে না। ‘

নারী পুরুষ সম্পর্ক বিশ্লেষণে লেখক নিয়ে এসেছেন ধর্মীয় ব্যাখাও, ‘যদিও তত্ত্বগতভাবে ইসলাম ধর্মে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার সম্ভবনা রয়েছে, তবু পর্দার মাধ্যমে মহিলাদের বিচ্ছিন্নকরণ এবং পুরুষের প্রতি আনুগত্য ইসলামি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। 

(চলবে...)