কবরী কড়চা: ফিল্মি নায়িকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:২২

“তখন তো আমি আওয়ামী লীগের কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না৷ একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, সাধারণ মানুষ, একজন অভিনেত্রী এবং শিল্পী হিসেবে মানবতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম৷ বাবা, মা, ভাই-বোন, সম্পদ, লোভ-লালসা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আমি ভাষণ দিয়েছিলাম এবং জনসম্মুখে কাঁদছিলাম এই জন্য যে পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছিল আমাদের দেশের মানুষদের উপর তার হাত থেকে যেন আমার দেশের মানুষ অতি দ্রুত রক্ষা পায়৷ সেজন্য আমি মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে যে আহ্বান জানিয়েছিলাম তার পরিণতি যে কী হতে পারে তা একবারও আমার মনে আসেনি এবং ভাবার কোন অবকাশও ছিল না৷” 

-কবরী সারোয়ার 


১৯৭১ সাল, ২৫ শে মার্চ। কবরী সারোয়ার ছিলেন চট্টগ্রামে। নিরাপত্তার খাতিরে তিনি ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। টানা তিনদিন তিনরাত হেঁটে রামগড়ের নারায়ণহাটে পৌঁছান। এবং এটি ছিলো তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। সেখানে পৌঁছে তার দেখা হয় আর্মি ক্যাপ্টেন কাদেরের সাথে। দুই সন্তান নিয়ে কবরী সারোয়ারের যখন বিচলিত অবস্থা তখন ক্যাপ্টেন কাদের তাদের আস্থা দেন। সাথে নিয়ে সাব্রুম সীমান্ত পার করে পৌঁছে দেন আগরতলায়। কবরী সারোয়ারের জীবনের দুঃসহ ও দুঃখের স্মৃতি হয়ে টিকে আছেন ক্যাপ্টেন কাদের। কারণ আগরতলা থেকে ফেরার পথে শহীদ হন তিনি। কবরী সারোয়ারের ভাষ্যমতে: আমাকে এভাবে পৌঁছাতে না গেলে ক্যাপ্টেন কাদের শহীদ হতেন না।

১৯ এপ্রিল, কবরী সারোয়ার আগরতলা পৌঁছান। সেখানে হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলো। জায়গার সংকুলান না হওয়ায় কেউ গাছের তলে, কেউ খোলা আকাশের নিচে; সে এক করুণ দৃশ্য। কবরী সারোয়ারকে শরণার্থী ক্যাম্পে দেখতে পেয়ে তৎকালীন যুগান্তর পত্রিকার সংবাদিক অনীল ভট্টাচার্য তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে কবরী সারোয়ার প্রায় ১০-১২ দিন অবস্থান করে চলে যান কলকাতার দীপঙ্কর দে'র বাড়িতে। মূলত তার কাজ তখন থেকেই শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের তহবিল গঠনের কাজ করতে থাকেন কবরী। তিনি কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর সাথে দেখা করেন। আয়োজন করেন ‘জয় জোয়ান নাইট’ নামের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। শ্রীমতি নার্গীস, সুনীল দত্ত, ধর্মেন্দ্র, শত্রুঘ্ন সিনহা, অংশুমান রায়, সলিল চৌধুরীসহ আরো অনেক খ্যাতনামা শিল্পী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেন কবরী সারোয়ার। অনুষ্ঠানে সংগৃহীত টাকা পাঠাতেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের। তার প্রধান লক্ষ্য ছিলো জনমত সৃষ্টি করা। আর সেজন্য তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে থাকেন। 
সেই সময়কার স্মৃতিচারণ করে কবরী সারোয়ার বলেন-

‘‘সেখানে একটি অনুষ্ঠান হয়৷ আমি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম৷ সেখানে আমি তুলে ধরি, কীভাবে আমি আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায় সেখানে পালিয়ে যাই৷ সেটা বলতে বলতে আমি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন করি যেন আমার দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য, আমার মা-বোনকে বাঁচানোর জন্য৷ তারপর আমি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ি৷ আর কিছুই জানি না৷”

কবরী সারোয়ারের এই বিখ্যাত কথাবাণী প্রায়ই প্রচার হতে থাকে তৎকালীন আকাশবাণীতে। তার এই বক্তব্য তার বাবা-মা সহ অনেক মুক্তিকামী মানুষ শুনেছিলেন; একথা কবরী সারোয়ার জানতে পারেন স্বাধীনতার পর।


মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একপর্যায়ে কবরী সারোয়ার চলে যান বোম্বে। এখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সম্মেলনে তিনি যোগ দেন, সেখানে তিনি বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষ ও তাদের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরতেন। বোম্বেতে তিনি এক সর্বপার্টি বাংলাদেশ সংহতি সম্মেলনে একটি বিশেষ পন্থা বের করে বাংলাদেশের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরার প্রয়াস করেন। তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গ্রাম-বাংলার সাধারণ মেয়েদের মতো ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা করেন- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি......।

এই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ভি. কে. কৃষ্ণমেন, অনন্ত রাম যোশী, আই এস জোহর, ব্লিটস সম্পাদক আর. কে. কারান জিয়া, এম. জে. আকবর, এ ইউসুফ আহমদ এমএনএ যোগ দেন। সকলের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন কবরী সারোয়ার। কবরী সারোয়ারের এইরূপ বেশে গান গাওয়ার ছবি ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট বোম্বের সাপ্তাহিক পত্রিকা ব্লিটস-এ প্রকাশ পায়। কবরী সারোয়ারের এই অসহায় ছবিটি প্রকাশ পাবার পর সত্যি বাংলাদেশে কি ঘটেছে তা জানার জন্য আগ্রহী হয়ে পড়েন বিশ্ববাসী। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আসতে শুরু করে বাংলাদেশের খবরাখবর। কবরীর এই কৌশল অবলম্বনের কারণেই বাংলাদেশের তৎকালীন অবস্থা নিয়ে বিশ্ব নেতাদের মধ্যে জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। কবরী সারোয়ার বাংলাদেশের দৈনিক যুগান্তর সহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন।

দেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বিভিন্ন স্থানে- হায়াদরাবাদ ও পুনান স্কুল, কলেজ ও চার্চগুলোতে বক্তব্য রাখেন কবরী সারোয়ার। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের ঘটনা তুলে ধরেন তিনি, বলেন তারা কিভাবে বাংলাদেশের নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে সেই ঘটনাসমূহ; কি করে শত শত নিরস্ত্র মানুষকে মেরে ফেলছে সেসব কথা। অনুরোধ জানান সবাইকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে, দেশবাসীর সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য। এইরকম একটি বক্তব্য রাখার সময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভারত যে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন কবরী সারোয়ার৷ তিনি জানান, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সেসময়ের জনপ্রিয় বড় মাপের সংগীত পরিচালক, সংগীত শিল্পী ও অভিনয় শিল্পীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠান করেছেন তিনি৷ এভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ ও পোশাক সংগ্রহ করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্র জগতে মনোনিবেশ করেন কবরী সারোয়ার৷ কবরী সারোয়ার অতীত-বর্তমান সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বলেন-

“দেশের জন্য লড়াই করতে পেরেছিলাম বলে আমি গর্ববোধ করি। এছাড়া আমার দুই ছোট্ট শিশুও সে সময় আমার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। এটাই আমার সবচে' গর্ব ও সার্থকতার বিষয়। এখন আমার উপলব্ধি হয় যে, মানুষকে তো মরতেই হবে। তাই এমন কিছু করেই মরা ভালো। আমার এখন মরতেও দ্বিধা নেই। যা হোক, আজও আমি বাংলাদেশের সাংসদ হয়ে লড়াই করে যাচ্ছি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন্য। নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নের জন্য লড়াই করে যাচ্ছি। তবে আমি যেহেতু একজন মুক্তিযোদ্ধা যে সাহসের সাথে লড়াকু সৈনিক হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলাম যুদ্ধক্ষেত্রে তার তুলনায় আমার বর্তমান লড়াই তো তেমন কিছু না। তাই এই লড়াইয়েও জয়ী হবো সেই প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।” 


তার জন্ম ১৯৫২ সালের ১৯ জুলাই চট্রগ্রামে। তার মূল নাম মীনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা পাল। ১৯৬৪ সালে মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি মঞ্চে আসেন। ধীরে ধীরে টেলিভিশন ও সিনেমা জগতে তার পদার্পণ। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং' ছবির নায়িকা হিসেবে অভিনয় জীবনের শুরু কবরীর৷ এরপর থেকে প্রায় একশ'টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি৷ এগুলোর মধ্যে হীরামন, ময়নামতি, চোরাবালি, পারুলের সংসার, বিনিময়, আগন্তুক'সহ জহির রায়হানের তৈরি উর্দু ছবি ‘বাহানা' এবং ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উল্লেখযোগ্য৷  

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি৷ যুক্ত রয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে৷ 

তথ্যসূত্রঃ
ক. ৭১ এর একাত্তর নারী (সুপা সাদিয়া) [কথাপ্রকাশ; ফেব্রুয়ারি ’১৪]

লেখক: কবি ও নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত