ভাষা সেনানী রওশন আরা বাচ্চু

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৪৪

জাগরণীয়া ডেস্ক

ভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৪৯ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হন রওশন আরা বাচ্চু। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছেন। ফেব্রুয়ারির উত্তাল আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অংশ নিয়েছেন, বক্তব্য রেখেছেন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এ সময় যে সব ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করাই আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন মনে করেন, রওশন আরা বাচ্চু তাদের মধ্যে একজন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একত্রিত করে আমতলার সমাবেশস্থলে নিয়ে আসেন। তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত করেছিলেন চারদিকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশস্থলটির বাইরে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। শাফিয়া খাতুন লাঠির ওপরে দিয়ে লাফিয়ে এবং হালিমা খাতুন নিচ দিয়ে বের হয়ে গেলেও রওশন আরা বাচ্চু তা করেননি। তার ভাষায়, ‘আমি দেখলাম, দুটি দলের কেউ কেউ পুলিশের কর্ডন লাঠির উপর দিয়ে এবং কেউ কেউ লাঠির নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি তা দেখে থর থর করে কাঁপছি। আমার মধ্যে জেদ চেপে বসল। মনে মনে স্থির করলাম, আমিতো মাথা নত করে যাব না এবং লাঠির উপর দিয়েও যাব না। যেতে হলে ব্যারিকেড ভেঙে তবেই যাব এবং তৃতীয় দলের সঙ্গে বেরিয়ে আমিই প্রথম ব্যারিকেড ভেঙেছিলাম।’ এদিকে পুলিশ ব্যারিকেড ভাঙার দৃশ্য দেখামাত্রই লাঠিপেটা শুরু করে দেয়। লাঠির আঘাতে তিনি আহত হন।

সেদিন বিকেলে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন বক্তব্য রাখতে গিয়ে যে দুজন আহত ছাত্রীর পরিচয় তুলে ধরেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেগম রওশন আরা বাচ্চু। এরই মধ্যে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী এলাকা পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। তখন রওশন আরা বাচ্চু পাশে স্তূপীকৃত ভাঙা রিকশার নিচে গিয়ে আশ্রয় নেন। সময় বুঝে পরে এসএম হলের প্রভোস্ট ড. গনির পাশ্ববর্তী বাড়িটিতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য রওনা হন। সে বাড়িটির কাঁটাতারের সঙ্গে শাড়ির আঁচল আটকে যায় তার। এ সময় কেউ একজন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। অবশেষে তিনি কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ড. গনির বাসায় আশ্রয় নিতে সক্ষম হন।

বিশ্বাবিদ্যালয়ের প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে সে সময় ১০ টাকা জরিমানা করা হতো মেয়েদের। আন্দোলনে গেলে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার পারিবারিক হুমকিও ছিলো। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত অন্যান্য সভা ও সমাবেশে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। কোন ভয়ভীতি তাকে ভাষাচেতনার আদর্শ থেকে এতটুকুও বিচ্যুত করতে পারেনি।

১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন রওশন আরা বাচ্চু। তার বাবা এম আফরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। ১৯৪৭ সালে রওশন আরা বাচ্চু শিলং লেডি কিন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৯ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক সম্মান পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে বিএড এবং ১৯৭৪ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ প্রন্ট’-এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন।

পরবর্তীকালে ঢাকার আনন্দময়ী গার্লস স্কুল, নজরুল একাডেমী, কাকলী হাইস্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইমেন্স স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন।

রওশন আরা বাচ্চু ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল সোয়া ১০টার সময় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি বেশকিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন।

তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত