মায়ানমারের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অং সান সু চি

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০১৭, ২০:৪৮

জাগরণীয়া ডেস্ক

বিংশ শতাব্দীতে যে বিদুষী নারী স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নারী ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে নোবেল শান্তি পুরুস্কার পান তাঁর নাম অং সান সু চি (Aung-Sun Suu-kyi)। ১৯৪৫ সালে অং-সান-সুচি বার্মা, বর্তমানে মায়ানমারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খিন-চি (Khin-kyi) এবং তাঁর মায়ের নাম অং-সান (Aung-San)। অং সান সু চি নিজ পরিবারের তিন সদস্যদের কাছ থেকে তার নামের পদবী গ্রহণ করেন। তার পিতার কাছ থেকে ‘অং সান’, তার পিতার নানী থেকে ‘সু’ এবং ‘চি’ তার মা খিন চির থেকে। তাকে প্রায়শই ডাউ অং সান সু চি নামে ডাকা হয়।

তাঁর পিতাকে আধুনিক বার্মার প্রতিষ্ঠা বলা হয়। কারন তিনি ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্য একটি জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করেন। বহুদিন মায়ানমার স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল এবং মায়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনে খিন-চি নেতৃত্ব দেন। অং সান সু চি তাঁর পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয়। পিতার রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং সংগ্রামী জীবনে অং-সান অনুপ্রাণীত হন। এই কারনে তিনি যখন বড় হলেন তখন তিনি দৃঢ় সংকল্প করলেন যে, তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। তিনি তাঁর পিতার মতো দেশপ্রেমিক এবং কূটনীতিবিদ হবেন।

অং-সান ভারতে শিক্ষাজীবন করেন এবং সেখানে অবস্থানকালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি অহিংসা দ্বারা রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৬৭ সালে ভারতে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে তিনি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের St. Hughes College-এ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ইংল্যান্ডে মাইকেল আরিস নামে এক ব্রিটিশ অধ্যাপককে বিয়ে করেন। প্রথম জীবনে তিনি বার্মা ও জাপানে বাস করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে ইংল্যান্ডে স্বামীর সাথে বসবাস করেন। বিয়ের এক বছর পরই প্রথম সন্তান আলেক্সান্ডারের জন্ম। দ্বিতীয় সন্তান কিমের জন্ম ১৯৭৭ সালে। ১৯৮৮ সালে অং-সান তাঁর মাতার অসুস্থতার কারনে মায়ানমারে ফিরে আসেন। তখন মায়ানমার Ne Win নামে এক স্বৈরাচারী সামরিক শাসকের কবলে ছিল এবং তিনি নির্বিচারে তাঁর বিরোধীদের হত্যা করতেন। ১৯৬২ সালে Ne Win ক্ষমতালাভ করার পর থেকে এই স্বৈরাচার অব্যাহত ছিল। বহু লোককে বিনা বিচারে কারাগারে আটক করা হত। এই নিস্পেষণ ও একনায়কত্ব বন্ধের জন্য তিনি অন্যান্য বিরোধী-দলের নেতাদের নিয়ে National League for Democracy প্রতিষ্ঠা করলেন। এই লীগ সার্বভৌমত্ব, স্বাধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রভৃতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। Ne Win একজন সামরিক শাসক ছিলেন এবং অং-সানসহ সকল বিরোধীদল সামরিক জান্তার স্বৈরাচারী শাসনের নিন্দা করে। তিনি প্রথম দিকে সামরিক বাহিনীর সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করতে চান। তিনি এগারো মাস ধরে সমগ্র মায়ানমারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণ করে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন এবং সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তাঁর এই আন্দোলনে শঙ্কিত হয়ে ডিক্টেটর Ne Win অং-সানকে হত্যার জন্য ছয়জন সৈন্যকে নির্দেশ দেন কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তিনমাস পর তাঁকে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৮৯ সালে গৃহবন্দী করা হলো তাঁকে এবং বহুদিন তিনি এই অবস্থায় ছিলেন। তাঁর গৃহের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়। পারিবারিক জীবনেরও সমাপ্তি ঘটল সেখানেই। এরপর প্রায় দুই দশক গৃহবন্দী ও কারাগারে কাটালেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে শেষ দেখা ১৯৯৫ সালের বড়দিনে হলেও ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এর চার বছর পর স্বামী মারা যান। ২০১০ সালে ১২ বছরের মধ্যে প্রথম ছোট ছেলে কিমের সাক্ষাৎ পান। চাইলেই তিনি মুক্তি পেতে পারতেন। কিন্তু স্বামী-সন্তানকে দেখতে একবার দেশ ছাড়লে আর কখনোই তাঁকে দেশে ঢুকতে দেয়া হবে না। তাই দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে বন্দীজীবনকেই বেছে নিলেন। বিয়ের আগে স্বামী মাইকেলকেও বলে রেখেছিলেন সবকিছুর আগে তাঁর দেশ।
যদিও National League for Democracy ১৯৯০ খ্রিঃ নির্বাচনে জয়লাভ করে কিন্তু সামরিক জান্তা অং-সানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এই নেতা ১৯৯০ সালে রাফতো পুরস্কার এবং শাখারভ পুরস্কার লাভ করেন। সামরিকতন্ত্রের বিপক্ষে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য ভারত সরকার তাকে ‘জওহরলাল নেহেরু’ পুরস্কার প্রদান করে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত