একাত্তরের লড়াকু ফুলমতি রানী

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৭, ১৬:১৯

মারুফ ইসলাম

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা এনেছিলেন যাঁরা তাদের মিছিলে আছেন অসংখ্য বীরাঙ্গনার নাম। তাঁদের শরীর, সম্ভ্রম, রক্ত আর চোখের জলে নির্মিত হয়েছে একটি মানচিত্র-যার নাম বাংলাদেশ। রাজকুমারী ফুলমতি রানী রবিদাস সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। ত্যাগস্বীকারী মহিয়সী এই নারীকে নিয়ে লিখেছেন মারুফ ইসলাম।


ছোট্ট ছাউনি দেওয়া একটা ঘর। দরজার টিনে জং ধরে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। এই ঘরেই দিনাতিপাত করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ফুলমতি রানী। আপনি যদি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলা সদরের উত্তরপাড়া এলাকার রাস্তার ধারে একটু হেঁটে যান তাহলেই দেখতে পাবেন খাসজমিতে টিন, বাঁশ আর খড়ের তৈরি একটা বাড়ি। এই বাড়িতেই ছেলে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাস করেন একাত্তরের বীরাঙ্গনা ফুলমতি রানী।

বয়সের কোটা ষাট পেরিয়ে গেছে। চোখে ভালো দেখতে পান না। কারো সাহায্য ছাড়া একা চলতে পারেন না। সারা শরীরে অসুস্থতা জেঁকে বসেছে। তবু মাঝে মাঝে তাঁর স্মৃতির বারান্দায় রোদ ওঠে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান, একাত্তরের কার্তিক মাসের মাঝামাঝি একদিন। দুপুর বেলা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল আচমকা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। স্বামী ফসিরাম রবিদাসকে অস্ত্রের মুখে বেঁধে ফেলে হায়েনার দল। তারপর তারা ফুলমতির ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন চলে এই অত্যাচার।

রাষ্ট্রের কাছে কোনো চাওয়া নেই এই বীরাঙ্গনা নারীর। রাষ্ট্র তাঁকে মুক্তযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিল কি দিল না, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তালিকায় তাঁর নাম আছে কি নেই এসব নিয়ে তাঁর নাকি মোটেও ভাবতে ইচ্ছে করে না। তিনি শুধু চান, মৃত্যুর পর মরদেহ দাহ করার সময় যেন মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর সন্তানদের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়ায়। সেটাই হবে তাঁর বড় স্বীকৃতি!

তখন সাদুল্যাপুরের আশপাশের এলাকায় হানাদারদের ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধের সময় ফসিরাম বিভিন্নভাবে তাঁদের সহায়তা করতেন।এটাই ছিল ফসিরামের অপরাধ! এরপর এপ্রিল মাসে হানাদাররা সাদুল্যাপুরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি ক্যাম্প করলে মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে নিরাপদে সরে যায়। অনেকেই ফুলমতিদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বললেও তাঁদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। তাই চোখভরা জল নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছেন এই অসহায় নারী।

চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ফুলমতির সংসার। ১৯৮৮ সালে স্বামীকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাঁকে। দিন এনে দিন খাওয়া সংসারে অনেক লড়াই-সংগ্রাম করেই ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। একপর্যায়ে বংশানুক্রমিক জুতা সেলাই পেশায়ও নামতে হয়েছে তাঁকে। মেয়ে সপ্তমী রানীর বিয়ে দেওয়ার পর তৃতীয় ছেলে মনিরাজের ওপর ভর করেই বেঁচে আছেন তিনি। অন্য ছেলেরা আলাদা হয়ে গেলেও ছোট ছেলে সুজন ও এক নাতনি আছে তাঁর সংসারে। দিন দিন তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। কানেও কম শোনেন। মাঝেমধ্যে তলপেটের ব্যথায় ছটফট করেন। দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এলেও সেই চোখে জলের ধারা কখনো শুকায় না ফুলমতি রানীর। তাঁর আছে অশ্রু-সমুদ্র!

রাষ্ট্রের কাছে কোনো চাওয়া নেই এই বীরাঙ্গনা নারীর। রাষ্ট্র তাঁকে মুক্তযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিল কি দিল না, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তালিকায় তাঁর নাম আছে কি নেই এসব নিয়ে তাঁর নাকি মোটেও ভাবতে ইচ্ছে করে না। তিনি শুধু চান, মৃত্যুর পর মরদেহ দাহ করার সময় যেন মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর সন্তানদের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়ায়। সেটাই হবে তাঁর বড় স্বীকৃতি!

তথ্যঋণ : প্রথম আলো ও কালের কণ্ঠ
প্রথম প্রকাশ: প্রমিনেন্ট বাংলা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত