মায়ের অপহরণ ও মৃত্যু যন্ত্রনার বর্ণনা

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০১৬, ১৪:২৫

মো. সুমন জাহিদ

আমার মা। সেলিনা পারভীন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। তাঁর হারিয়ে যাওয়ার কাহিনীটা আমার কাছ থেকে কোনদিন হারিয়ে যাবে না। যেমন যায়না অন্যসব সন্তানের ক্ষেত্রেও। আমার মায়ের হারিয়ে যাওয়ার দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্ভাগ্যজনক দিন।

সেদিন ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হবে হবে। কোনো কোনো অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেছে। শীতের সকাল। এ সময় স্নান করার আগে আম্মা আমার শরীরে ভালো করে তেল মাখিয়ে দিতেন। তেলমাখা গায়ে রোদে খেলাধূলা করে তারপর স্নান করতে যেতাম। আমরা থাকতাম সিদ্ধেশ্বরীতে, তৎকালীণ ১১৫ নং নিউ সার্কুলার রোডে। আমাদের বাসায় আমরা তিনজন মানুষ থাকতাম। আমি, মা আর আমাদের উজির মামা। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। আমাদের বাসার উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে ঊ.চ.জ.ঞ.ঈ-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামে। সেই বাসার মেইন গেইট ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু লোক। আমরা তিনজন ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্যটা দেখি। কিছুক্ষণ পর আম্মা আমাকে গোসল করানোর জন্য নিচে নিয়ে আসে। গোসলের পর আমি আবার ছাদে চলে যাই। আম্মা তখন রান্না করতে যান। উজির মামা ও আমি আবার ছাদে চলে আসি। এরপর আবার গাড়ির শব্দ। এবার একটি গাড়িটি এসে থামে আমাদের বাসার সামনে। ছাদে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আমরা দেখি কয়েকজন লোক আমাদের বাসায় ঢুকছে। তাদের সবারই একই রঙের পোষাক ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এরা বাসার মেইন লোহার কলাপসিবল দরজার কড়া নাড়ছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বের হয়ে কলাপসিবল গেইট খুলে দেয়। গাড়িতে করে আসা লোকগুলো ভদ্রলোকের কাছে সেলিনা পারভীনের পরিচয় জানতে চায়। ভদ্রলোক আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন। ভদ্রলোককে ঘরে চলে যেতে বলে লোকগুলো আমাদের ফ্ল্যাটে এসে নক করে। আম্মা দরজা খুলে দেয়। তারপর লোকগুলো আম্মার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং বাসায় কে কে থাকে তাও জেনে নিল। এ সময় আম্মার সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। আমি আর উজির মামা ততক্ষণে সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা উঁকি দিলে ওরা দেখে ফেলে। আমাদের দিকে বন্দুক তাঁক করে। আমি ও উজির মামা ভয় পাই। আম্মা আমাদের ডেকে নিয়ে লোকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি আম্মার কাছে চলে আসি। এরপর আম্মাকে তাদের সাথে যেতে বলে লোকগুলো । আম্মা লোকগুলোকে বলেন, বাইরে তো কারফিউ। এখন যাব কীভাবে। লোকগুলো বলে, আমাদের সাথে গাড়ি আছে। তাছাড়া আমাদের সাথে কারফিউ পাশও আছে। কোন সমস্যা হবে না। ওরা নাছোড়বান্দা, আম্মাকে নিয়ে যাবেই। আম্মা তখন বলেন, ঠিক আছে। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি শাড়ি বদল করে আসি। ওরা বাধা দেয়। বলে, দরকার নেই। গাড়িতে করে যাবেন আবার গাড়িতে করেই ফিরে আসবেন।

আমিও তখন আম্মার সাথে যেতে চাই। কিন্তু লোকগুলো আমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘বাচ্চা লোক নেহি জায়েগা’। আমি তখন মায়ের খুব কাছে। মার হাত ধরে আছি। আম্মা আমার মাথা ও গালে হাত বুলান। তিনি আমাকে বলেন, সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসবো। এই ছিল আমার জীবনে আম্মার কাছ থেকে শোনা শেষ কথা। ওরা আমাকে ও মামাকে ঘরের ভিতর চলে যেতে বলে। উজির মামার সাথে মা কথা বলার সুযোগ পেলেন না। মামা আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলেন। উজির মামা দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। আমি মাকে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকি, অনেকটা ঝাপসাভাবে। মা রান্নার সময় কোমড়ে একটা গামছা ঝুলিয়ে রাখতেন ময়লা হাত মোছার জন্য। ওরা মার কোমড় থেকে সেই গামছাটা নিয়ে নিল। তারপর চোখ বাঁধল। হাত পিছমোড়া করে বাঁধল। ওরা আম্মাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। একটু পরে মামাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা বন্দুক নিয়ে কেন আসলো? আম্মার কাছে কেউ তো এভাবে আসে না।’ আম্মা চলে গেলেন আর ফিরে এলেন না।

আম্মা আমাকে ছেড়ে কখনো কখনো কাজের তাগিদেই বাড়ির বাইরে ফেনী বা অন্য কোথাও যেতেন। ফলে আট বছর বয়সী আমার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। আম্মার এক-দু’দিনের অনুপস্থিতিতে আমি আগে থেকেই অভ্যস্ত ছিলাম। আমার শিশুমন ধরেই নিয়েছিল বরাবর আম্মা যেমন আমার কাছে ফিরে আসে এবারও তাই হবে। আম্মা কেন আসে না বা আমি আম্মার কাছে যাব এসব বায়না যখন ধরতাম তখন উজির মামা আমাকে নানা প্রবোধ দিতেন। আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকতাম। ১৪ তারিখ কেটে গেল। ১৫ তারিখ সারাদিন কেটে গেল। ওইদিন বিকালেই আমি আর উজির মামা সিদ্ধেশ্বরী থেকে তাদের বাংলামটরের (সাবেক পাকমটর) বাসায় চলে আসি। সেখানে গিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধূলায় মেতে যাই। পরদিন দেখি হাজার হাজার পাকিস্তানি আর্মি দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে রাস্থা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ১৬ ও ১৭ তারিখ সেখানেই থাকি। ১৭ ডিসেম্বর রাতে যাই সেজ মামার বাসায়। পরে আমি অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি ১৮ ডিসেম্বর আমার মায়ের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ১৪ ডিসেম্বর আরো অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই তাঁকে হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বরেই তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়। মা ছিল একটু শীত-কাতুরে। সবসময় পায়ে মোজা আর স্কার্ফ ব্যবহার করতেন। ১৩ ডিসেম্বর যেদিন বাড়ি থেকে আম্মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো তখন তাঁর পরনে ছিল সাদা শাড়ি-ব্লাউজ, সাদা স্কার্ফ, পায়ে সাদা জুতা ও মোজা। ফলে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাঁকে অনেক শহীদের মধ্যেও আমার আত্মীয়রা সনাক্ত করতে পারলেন সহজেই।

তাঁর অপহরণ এবং মৃত্যু যন্ত্রনার করুণ বর্ননা..

চৌধুরী মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী আমার মা সহ ঢাকার অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার মাকে ধুরী মঈনউদ্দিন চিনতো, তার গ্রামের বাড়ী ও আমাদের বাড়ী একই জেলায়-ফেনীতে। ঢাকায় যখন মা তার লেখা (প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা) ছাপানোর জন্য দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় যেতেন, তখন সে মার সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতো। কোন এক সময় কৌশলে সে মার ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল। পাকিস্তানী মিলিটারীদের পক্ষে এত মানুষের ঠিকানা সংগ্রহ করা সহজ ছিল না যদি না চৌধুরী মঈনউদ্দিনের মত লোকেরা প্রত্যক্ষ ভাবে এই হত্যা যজ্ঞের সহায়তা না করত। সুতরাং চৌধুরী মঈন উদ্দিনই আমার মার হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত বলে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।

স্বাধীনতার আরো পরে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এসে প্রজন্ম ‘৭১ এর এক আনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালে রায়েরবাজার থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে আসা একমাত্র মুক্তিযোদ্ধার (জনাব দেলোয়ার হোসেন- পরে আনেক পত্রিকায় ও টিভিতে দেওয়া স্বাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন) কাছে, আমার মায়ের মৃত্যুর পূর্বে যে যন্ত্রণার সম্মুখিন হয়েছিলেন তা জানতে পাড়ি। তা হলো – ১৩/১২/১৯৭১ দুপুরে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের প্রায় ৩০ জনকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একটি ঘরে বন্দী করে রেখেছিল ঘাতকেরা। সেখানে ছিল না কোন আলো-বাতাস, ছিল না কোন পানি কিংবা খাদ্য, এমনি বাথরুম সুবিধার কোন ব্যবস্থা ছিল না। অনেকজন পুরুষের মাঝে তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা, সেখানে সবারই হাত এবং চোখ বাধা ছিল কেবল মুখ দিয়ে একে অন্যের পরিচয় জানছিলেন। অনুমান করা যায় একজন মহিলার পক্ষে এই সময়টা কতটা কষ্টের কতটা যন্ত্রণার এবং লঞ্ছনার। এই ভাবেই দেলোয়ার হোসেন জেনেছিলেন তার পাশের বন্দীর নাম মোফাজ্জল হায়দার চৌধরী, তিনি ছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের সকলের পিছনে ছিলেন একজন মহিলা, তিনি কাঁদছিলেন। নাম জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলেন, তাঁর নাম সেলিনা পারভীন। (দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছিলেন তিনিই শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিক – ‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন”।) যখন তাদের রায়ের বাজার বধ্যভুমিতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমার মা সহ সকলেই পরবর্তী পরিণতি সর্ম্পকে একটা ধারণা পেয়েগিয়েছিলেন। আর তাই মা তখন অনুনয় বিনয় করে বলেছিল তাকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। ঐ পরিস্থিতিতে তাকে ঘিরে একটা ছোট জটলার সৃষ্টি হয়। মা তখন বলেছিলেন তিনি আর লিখবেন না, পত্রিকা বের করবেন না। এই সব কথায়ও কাজ না হওয়ার তিনি তখন তাদের কাছে অনুনয় করে বলেছিলেন, ঘরে আমার একটা শিশু সন্তান আছে, তাকে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাব আর ফিরবো না, অন্ততঃ পক্ষে সেই কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অথচ ঘাতকরা তখন তার মুখে বেয়নেট চার্জ করে মুখ ফেড়ে দেয়। মহিলা মানুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং ব্যথায় চিৎকার করেছিলেন, নরপিশাচেরা তখন তার বুকেও বেয়নেট চার্জ করে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এবং আরো জোরে সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার (গোঙ্গানী) করতে থাকেন । হায়নারা তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এই সুযোগে দেলোয়ার হোসেন হাতের বাধন খুলে পিছন দিক থেকে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন। তাকে গুলি করা হয়, অলৌকিক ভাবে তিনি বেঁচে যান। বাচঁতে পারলেন না আমার মা! কি অপরাধ ছিল তাঁর? মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা? দেশের প্রায় সব চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকা ‘শিলালিপি’? তাঁর নিজস্ব সাহিত্য-কবিতা-, লেখা? ১৯৭১ সালে তিনি নিজেকে মুক্তি সংগ্রামে জড়িয়ে ফেলা? সভা-সমাবেসে যোগদেওয়া? যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেই বাসার মালিকেরই কারসাজি?

কিন্তু আমি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে জানতে পারি আমার মা আর বেঁচে নেই। আমি জানতে পারি মা আর কখনোই আমার গায়ে তেল মেখে দেবেন না। আমার জন্য আর তিনি কোনদিন চকলেট নিয়ে আসবে না। আত্মীয়রা আমাকে বললো, আমার মা আল্লার কাছে চলে গেছে। ‘দুঃখ হয়, মা নেই, আমি মার স্নেহ বঞ্চিত। কিন্তু সেই সাথে গর্বিত বোধ করি এই জন্য যে, আমার মা বাংলাদেশের একজন শহীদ। এই দেশের মাটি ও মানচিত্র দেখলেই মার কথা মনে পড়ে। এই মানচিত্রের জন্য মা জীবন দিয়েছেন।’ কিন্তু… ‘ওই ঘৃণিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির শয়তানগুলো আজ সমাজে বড় বড় আসনে অধিষ্ঠিত আর মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত। যখন দেখি শহীদের প্রাপ্ত সম্মান তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না, তখন প্রচণ্ড দুঃখবোধ হয়। স্বাধীনতার মূল্যবোধ আজ পদদলিত। পশুরা আজ অন্য সুরে কথা বলে, খুনীরা মন্ত্রী হয়। এই জন্যই কি আমার মা ও শত শহীদরা তাদের আত্মা বিসর্জন দিয়েছিলেন? হত্যাকারীদের বিচার হলো না। আমরাতো হত্যার বদলে হত্যা হোক তা চাই না। যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এই আমাদের দাবি।’ আমি এই হত্যা কান্ডের উপযুক্ত বিচার প্রার্থনা করি। এখন আমাদের সকলের একটাই চাওয়া, তা হলো এই জীবনদসায় যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখে যাওয়া। তবেই সকল শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন এর পুত্র

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত