প্রকাশ্যে মাতাল ব্যক্তির অশোভন আচরণের শাস্তি

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:২৩

জাগরণীয়া ডেস্ক

ধারা
প্রকাশ্যে মাতাল ব্যক্তির অশোভন আচরণ
যে ব্যক্তি প্রমত্ত অবস্থায় কোন প্রকাশ্য স্থানে, অথবা যে স্থানে প্রবেশ করা তাহার পক্ষে অনধিকার প্রবেশের শামিল--এইরূপ কোন স্থানে হাজির হয় এবং উক্ত স্থানে এইরূপ আচরণ করে, যাহা কোন ব্যক্তির বিরক্তির উদ্রেক করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদন্ডে--যাহার মেয়াদ চব্বিশ ঘন্টা পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ডে যাহার পরিমান দশ টাকা পর্যন্ত হইতে পারে বা উভয়বিদ দন্ডে দন্ডিত হইবে।

ভাষ্য
বিশ্লেষণঃ এই ধারায় প্রকাশ্যে মাতাল ব্যক্তির অশোভন আচারণের শাস্তির বিধান রহিয়াছে। অপরাধী ব্যক্তির শাস্তি হইবে অনুর্ধ্ব চব্বিশ ঘন্টা কারাদন্ড বা অনুর্ধ্ব দশ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড।

প্রমাণ
এই ধারার অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে নিম্নবর্ণিত তথ্যাবলী প্রমাণ করিতে হয়
(১) অভিযুক্ত ব্যক্তি মাতাল ছিলেন।
(২) ঐ অবস্থায় তিনি কোন প্রকাশ্য স্থানে হাজির হইয়াছিলেন বা অনধিকার প্রবেশ করিয়াছিলেন।
(৩) তিনি উক্তভাবে এইরূপ আচরণ করিয়াছিলেন, যাহা কোন ব্যক্তির বিরক্তির উদ্রেক করে।

নারীর শালীনতার অমর্যাদা ও মাতালের অশোভন আচরণের অপরাধের বিচার (সংক্ষিপ্ত-সার)
এখন নারীর শালীনতার অমর্যাদার অপরাধের বিচারের বিষয় আলোচনা করা যাক। নারীর সহিত পুরুষের ব্যবহার হইবে শোভন ও শালীন। ‘শালীন’ শব্দের অর্থ নম্র, বিনয়ী ও ভদ্র। অশালীন হওয়া আইনের চোখে অপরাধ।

অধুনা শালীনতার অভাব প্রকট। শুধু শহরে ও উপশহরে নহে, গ্রামবাংলায়ও আজ মেয়েদের স্কুল স্থাপিত হইয়াছে। স্থানে স্থানে কলেজও। আমাদের মেয়েরা তাই বাহিরে আসিয়াছে অনেকখানি। দেখা দিয়াছে, রাস্তা, ঘাটে সুন্দরী যুবতী মেয়ে দেখিলে কেহ কেহ নিজের বিবেকবোধ হারাইয়া ফেলে। মেয়ে দেখিলে কেহ শিস দেয়, কাহারও হঠাৎ করিয়া কোন চটকদার সিনেমার গানের কলি মনে পড়ে। আবার কেউ আরও অগ্রসর হইয়া অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। নারীর শালীনতার অমর্যাদার অনেক রূপ আছে, আছে অনেক চরিত্র। কোন মেয়ের পিছনে দীর্ঘক্ষণ ঘুরঘুর করা; তাহার দিকে এক নয়নে তাকাইয়া থাকা, তাহার উদ্দেশ্যে কোন অশোভন মন্তব্য করা প্রাভৃতি নারীর শালীনতার অমর্যাদা করিবার শামিল। এই সমস্ত কুকাজ মেয়েদের জীবনকে বিষাইয়া তোলে, তাহাদের চলাফেরাকে বিঘ্নিত করে।

সারা বিশ্বে সকল যুগে নারীর পবিত্রতা উচ্চমর্যাদার স্থান পাইয়া আসিয়াছে। তাহার দেহকে ঘিরে সর্বদা একটা পবিত্রতা বিরাজ করুক, সমাজ তাই চায়। সে ব্যক্তি এই পবিত্রতাকে কুলষিত করিতে অগ্রসর হয়, সমাজ তাহাকে অপরাধী মনে করে।

ধরিয়া লওয়া হয় যে, প্রত্যেক নারী পবিত্র। যে অন্য রকম দাবি করে, প্রমাণের ভার তাহার উপর। সুতরাং কোন নারীর প্রতি অশোভন আচরণ করা কোন ক্ষেত্রেই নির্দোষ নহে।

নারীর শালীনতার অমর্যাদার অভিপ্রায় থাকিলেই তবে অপরাধ হইবে। কোন কথা বা কোন আচরণে বা কোন অঙ্গভঙ্গি বা কোন শব্দ অপরাধমূলক তাহা পরিনতির উপর নির্ভর করে। অপরিচিতা যুবতী মেয়ের দিকে তাকাইয়া শিস দিলে সেই কাজ নিশ্চয় অপরাধ; কিন্তু যে ছেলে কোন একটি বিশেষ মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন মন দেওয়া-নেওয়া করিয়াছে তার পক্ষে চোখ নাচান বা শিস দেওয়া আপরাধ নজে, আমন্ত্রণ।

নারীর কামরায় তাহাকে জ্বালাতন করিবার অভিপ্রায়ে যে ব্যাক্তি সেখানে প্রবেশ করে, সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে অপরাধী। কোন ব্যক্তির বাড়িতে কুকাজের জন্য ঢোকা অন্যায়, নারীর ঘরে তো নিশ্চয়ই। নিজের যে ঘরে নারীর বাস বা অবস্থান করে, সে ঘর ব্যবহারের অধিকার একমাত্র তাহারই। সেখানে সে সময় তাহার আব্রু সম্পর্কে সচেতন নাও থাকিতে পারে, সেইখানে কাহারও পক্ষে হঠাৎ প্রবেশ করা অন্যায় এবং অপরাধ। শুধু পুরুষ নহে নারীরাও এই অপরাধে অপরাধী হইতে পারে।

দন্ডবিধির ৫০৯ ধারায় বলা হইয়াছে, যে ব্যক্তি নারীর শালীনতার অমর্যাদা করিবার উদ্দেশ্যে কোন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে অথবা নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে সেই ব্যক্তি অপরাধী। 

এই ধারায় অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে নিম্নবর্ণিত তথ্যাবলী প্রমাণ করিতে হইবে
(১) অভিযুক্ত ব্যক্তি----
(ক) কোন মন্তব্য করিয়াছিলেন, বা
(খ) কোন শব্দ করিয়াছিলেন, বা
(গ) কোন বস্তু প্রদর্শন করিয়াছিলেন, বা
(ঘ) কোন নারীর নিভৃতবাসে অনধিকার প্রবেশ করিয়াছিলেন।

(২) অভিযুক্ত ব্যক্তি উপরোক্ত ক হইতে ঘ-এর ঐ সকল কোন নারীকে শুনাইতে বা দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

(৩) তাহা দ্বারা তিনি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করিতে অভিপ্রায় করিয়াছিলেন।

এইবার বলিব মাতালের বিরক্তির আচরণের কথা
যে ব্যক্তি প্রমত্ত অবস্থায় প্রকাশ্য স্থানে প্রবেশ করে এবং এমন কোন আচরণ করে যাহাতে অন্যের বিরক্তির উদ্রেক হয়, সেই ব্যক্তি অপরাধী। যে জায়গায় যাইবার অধিকার নাই, সেই যায়গায় সে যদি যায় এবং বিরক্তিকর আচরণ করে, তবে সে অপরাধী (দন্ডবিধির ৫১০ ধারা) আইনে মাতাল ব্যক্তির প্রকাশ্য অশোভন আচরণের শাস্তির বিধান করা হইয়াছে। অপরাপর অভিযোগে আদালতে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে, নিজের তথ্যাবলী প্রমাণ করিতে হইবে-

(১) অভিযুক্ত ব্যক্তি মাতাল ছিলেন।
(২) ঐ অবস্থায় তিনি কোন প্রকাশ্য স্থানে গিয়াছিলেন অথবা অনধিকার প্রবেশ করিয়াছিলেন।
(৩) তিনি এমন আচরণ করিয়াছিলেন যাহা কোন ব্যক্তির বিরক্তির উদ্রেক করে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে (বর্তমানে স্থগিত) ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বার্থের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ, অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্য হানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।

সংবিধান নির্দেশ দিয়াছে যে, স্বাস্থ্যগত বা অন্যবিধ কারণ ব্যতীত মদ্যপান বাংলাদেশে নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

ইসলামে মদ্যপান নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে এরশাদ ফরমাইয়াছেন। হে বিশ্ববাসীগণ মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্মায়ক সকল ঘৃণ্য বস্তু শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা উহা বর্জন কর যাহাতে তোমরা সফলকাম হইতে পারঃ শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাইতে চাহে এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণেও সালাতে বাধা দিতে চাহে। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হইবা না?

মদ্যপান সর্বসম্মত অভিমতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং যেকোন দিক দিয়া বিচার করা হোক না কেন, মদ খাওয়া অন্যায়।

চিকিৎসকের পরামর্শে অনেককে কিছু মদ জাতীয় পানীয় খাইতে হয়। আবার অমুসলিমদের মদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বাধানিষেধ নাই; তাহারা ইচ্ছে করিলে মদ খাইতে পারেন। দলে পড়ে বা নূতনত্বের জন্য অনেক মদ খাইয়া থাকেন। শীতের দেশের অমুসলিমগণ পানির পরিবর্তে মদ জাতীয় পানীয় গ্রহণ করেন। একবার মদ খাওয়া আরম্ভ করিলে আর অনেকে তাহা ছাড়িতে পারেন না। এই সকল কারণে কিছু কিছু মদ্যপান বাংলাদেশে চলে।

মদ খাইয়া মাতাল হইয়া বিরক্তিকর আচারণ করা অপরাধ। বিরক্তিকর আচারণ কি? বিরক্তিকর আচরণ বলিতে সেই রকম আচরণকে বুঝায়, যাহাতে সেই সাধারণ মানুষ বিব্রতবোধ করে। মানুষের মনের শান্তি যে আচারণ দ্বারা বিঘ্নিত হয়, সেই আচরণই বিরক্তিকর।

নিজের ঘরে মাতাল হওয়া অপরাধ নহে। প্রকাশ্য স্থানে মাতাল হইয়া বিরক্তিকর আচরণ অপরাধজনক। প্রকাশ্য স্থান বলিতে সেই স্থান বুঝায় যেখানে মানুষের যাতায়াত আছে। যদি ব্যক্তিগত জমির উপর মেলা বসে, সেই মেলাও প্রকাশ্য স্থান। মোটর, বাস, পার্ক, মেলা, মাঠ, হাট, প্রদর্শনী প্রভৃতি প্রকাশ্য স্থান বলা যায়।

যে জায়গায় যাহার যাইবার অধিকার নাই, সেই জায়গায় গিয়া বিরক্তির আচরণ করা অপরাধ। অন্যের বাড়িতে, দোকানে, জমিতে, কাহারও যাইবার অধিকার নাই, সেখানে গিয়া বিরক্তির আচরণ করা অপরাধ।

চার্জ
আমি (বিচারক ও ক্ষমতাসহ আদালতের নাম ইত্যাদি) আসামির/আসামিদের নাম.........আপনার/ আপনাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গঠন করিতেছে যে, আপনি/আপনারা............তারিখে.........টার সময় অমুক স্থানে মাতাল অবস্থায় অশোভন বিরক্তিকর আচরণ করিয়াছেন, যাহা দন্ডবিধির ৫১০ ধারামতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং আমার আদালতে বিচার্য।

[অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ গাজী শামছুর রহমান রচিত ‘দণ্ডবিধির ভাষ্য’ বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। বইটি সাধু ভাষায় রচিত]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত