দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত শেষে কবরস্থ রাওদার লাশ

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০১৭, ০১:২৯

জাগরণীয়া ডেস্ক

রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ও মালদ্বীপের মডেল রাওদা আতিফের দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত শেষে লাশ কবরস্থ করা হয়েছে।

২৪ এপ্রিল (সোমবার) দুপুর সোয়া ১২টা সোয়া ৩টা পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) মর্গেই দ্বিতীয়বারের মতো রাওদার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়।

পরে রাজশাহী মহানগরীর হেতেমখাঁ গোরস্থানের আগের কবরেই তার লাশ কবরস্থ হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক আসমাউল হকসহ সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

উপস্থিত ছিলেন রাওদার বাবা ডা. মোহাম্মদ আতিফও। দাফনের পর তিনি মেয়ের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করেন। এর আগে সকালে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সিআইডির কর্মকর্তারা রাওদার কবর থেকে লাশ তুলে রামেকের মর্গে নিয়ে যান। সেখানে তিন সদস্যর মেডিকেল বোর্ড গঠন করে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

ময়নাতদন্ত শেষে ময়নাতদন্তকারী বোর্ডের প্রধান সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আমিরুল চৌধুরী বলেন, ‘কিছুটা ডিকম্পোজড (অর্ধগলিত) ও কিছুটা প্রিজাভড (সংরক্ষিত) অবস্থায় আমরা লাশটি পেয়েছিলাম, যা ময়নাতদন্ত প্র্রতিবেদনে লেখা হয়েছে। তবে ঢাকা থেকে ভিসেরাসহ অন্য প্রতিবেদন না আসায় আমরা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে কোনো মন্তব্য লিখিনি।’

তিনি বলেন, ‘কিছুটা বোন, কিছু সফট টিস্যু আমরা প্রিজাভড করেছি। এই বিষয়টি খুবই চাঞ্চল্যকর, তাই আমরা কেমিক্যাল রিপোর্টসহ সবগুলোকে এক করে থানার মাধ্যমে ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেব।’

লাশের গলা কেমন পেয়েছেন, এমন প্রশ্নে ডা. আমিরুল চৌধুরী বলেন, সেই জায়গাটি নিয়ে আগে রিসার্চ হয়েছে। তাই বডির ওই জায়গাটি বেশি গলিত। তবে প্রথম ময়নাতদন্তের সঙ্গে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের কোনো মিল আছে কি না, এমন প্রশ্নের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি এই চিকিৎসক।

তার সঙ্গে এ সময় বোর্ডের অন্য দুই সদস্য নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুব হাফিজ এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফিজুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ২৯ মার্চ রাজশাহীর নওদাপাড়ায় ইসলামী মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হোস্টেল থেকে রাওদার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাওদা এ কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। নীলনয়না রাওদা ছিলেন মালদ্বীপের একজন উঠতি মডেল। মাত্র একুশ বছরের রাওদার ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি।

রাওদার লাশ উদ্ধারের দিন কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানিয়েছিল, তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় ওই দিনই কলেজ কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে নগরীর শাহমখদুম থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে। এরপর রামেকের মর্গেই রাওদার লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তে একটি মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল।

বোর্ডের তিন সদস্যর দু’জনই ছিলেন ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। ময়নাতদন্তের পরদিনই তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাওদা আত্মহত্যা করেছেন। পরে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত ও পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে গত ১ এপ্রিল রাওদার লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, রাওদাকে পরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

রাওদার বাবার অভিযোগ, প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তার এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা রাজশাহীতে এসে ঘটনা তদন্ত করেন। দেশে ফিরে গিয়ে তারা জানান, রাওদাকে হত্যার কোনো প্রমাণ তারাও পাননি।

রাওদার মৃত্যুর ঘটনায় কলেজের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটিও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, রাওদা আত্মহত্যা করেছেন। তবে গত ১০ এপ্রিল রাওদার বাবা ডা. মোহাম্মদ আতিফ রাজশাহীর আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর থেকে তিনি রাজশাহীতেই অবস্থান করছেন।

হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, রাওদাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এ মামলায় রাওদার সহপাঠি সিরাত পারভীন মাহমুদকে (২১) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। সিরাতের বাড়ি ভারতের কাশ্মিরে। সিরাতের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সিআইডি বলছে, হত্যার প্রমাণ না মিললে গ্রেপ্তার করা হবে না সিরাতকে। তবে এরই মধ্যে তার পাসপোর্ট অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। নজরদারির ভেতরেও রাখা হয়েছে তাকে।

রাওদার মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি তদন্ত করছিলেন শাহমখদুম থানার পরিদর্শক আনোয়ার আলী তুহীন। আর অপমৃত্যুর মামলাটি তদন্ত করছিলেন রাজশাহী মহানগর ডিবি পুলিশের পরিদর্শক রাশিদুল ইসলাম। রাওদার মৃত্যুর কারণ উৎঘাটনে তার কক্ষ থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ ও মোবাইলের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সেগুলো সিআইডির পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছেন রাশিদুল ইসলাম।
সে প্রতিবেদন এখনও ঢাকা থেকে আসেনি।

এরই মধ্যে গত ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে দুই মামলায় সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। সিআইডির পরিদর্শক আসমাউল হক মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পেয়েই তিনি রাওদার লাশের পুনরায় ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেন। এ জন্য লাশ কবর থেকে তুলতে সিআইডির এই কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করেন।

এরই মধ্যে সিআইডির কর্মকর্তারা রাওদার কক্ষের ফ্যানটি পরীক্ষার জন্য জব্দ করে। পাশাপাশি পুরো হোস্টেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও জব্দ করা হয়। সেগুলো পরীক্ষা করছে সিআইডি। এ ছাড়া রাওদার সহপাঠীসহ হোস্টেলের কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে। এরপরই সোমবার দাফনের ২৩ দিন পর রাওদার লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত করা হলো।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত