বিস্মৃতির চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে ভাগিরথীর স্বীকৃতি

প্রকাশ : ২৯ মে ২০১৬, ১৮:২৬

জাগরণীয়া ডেস্ক

বিজয়ের দীর্ঘ দিনেও স্বীকৃতি মেলেনি এক অকুতোভয় নারী মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পিরোজপুরের ভাগিরথী সাহার। ১৯৭১ এর ১৩ সেপ্টেম্বর মহকুমা শহরের কালো পীচ ঢালা পথে তার শরীরের ছোপছোপ রক্ত সেদিন একে দিয়েছিল লাল সবুজের পতাকা। অথচ ভাগিরথী সাহাকে বীরঙ্গনার খেতাবে আজও নাম ওঠেনি।

বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামের মুড়ি বিক্রেতা বসন্ত সাহার ঘরে ১৯৪০ সালে ভাগিরথীর জন্ম। বাবার আর্থিক অনটনের কারণে ভাগিরথীর ভাগ্যে সামান্য অক্ষরজ্ঞান লাভের সুযোগ ছাড়া বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৬ সালে পিরোজপুর সদর উপজেলার বাগমারা গ্রামের ৪০ বছর বয়সি প্রিয়নাথ সাহার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৬৭ সালে প্রিয়নাথ দু’টি শিশু পুত্র আর স্ত্রী ভাগিরথীকে রেখে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার পর পিরোজপুরসহ সারা দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৪ মে পিরোজপুরে পাকবাহিনী এসে শতশত নিরীহ মানুষ হত্যার সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

স্থানীয় রাজাকার ও মুসলিমলীগের সহযোগিতায় বাগমারা গ্রামের সবকটি বাড়ির সাথে সাহা পাড়ার ভাগিরথীর বাড়ির সব মালামাল লুট করে নেয় দুস্কৃতকারীরা। দু’পুত্র সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে ভাগিরথীর। উপায়ান্তর না দেখে প্রায় প্রতিদিন নৌকায় করে পিরোজপুর শহরে এসে বাসায় বাসায় ঝি-এর কাজ করে এক-দু সের চাল নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। কাজ না পেলে ভিক্ষা ছাড়া উপায় থাকে না। নৌকায় চড়ে শহরে আসা-যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিন মানুষের ভাসমান লাশ, কাক, কুকুর, শিয়াল, শকুনের লাশ নিয়ে কড়াকাড়ি এবং নিজের বর্তমান দূরাবস্তার জন্য পাকবর্বরদের উপর ভাগিরথীর ঘৃণা ক্রোধ বাড়তে থাকে, সে ভাবতে থাকে ওদের চরম শাস্তি দেয়ার কথা।

এদিকে মহকুমা সদরের বাগমারাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপড়তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৩ আগস্ট সরোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৭জন মুক্তিযোদ্ধা একপাই জুজখোলা গ্রামে অবস্থান নেয়। খবর পেয়ে মতিউর রহমান সরদারের নেতৃত্বাধীন দলটিও সরোয়ারের সঙ্গে মিলিত হয় এবং প্রথম দিনই পাকবাহিনীকে সহযোগিতা, নারী ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগের অপরাধে রাজাকার কমাণ্ডার আব্দুল আলীকে গণআদালতে মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর তারা শহর থেকে পাকবাহিনীর গতিবিধির খবর সংগ্রহের জন্য ভাগিরথীকে নিয়োজিত করে।

ভাগিরথী শহরে এসে পাকবাহিনীর ক্যাম্পের আসে পাশে ঘুরতে থাকে। তখন পাকবাহিনীর সুবেদার সেলিম ভাগিরথীকে প্রলোভন দেখিয়ে ক্যাম্পের ভিতরে নিয়ে যায়। বলে, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানাতে পারলে বহুত “বখশিস আছে, ইনামও আছে”। এভাবে প্রায়ই ভাগিরথী পাকহানাদারদের ক্যাম্পে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের অসত্য তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে সে ২৯ আগস্ট পাক বর্বরদের বাগমারায় নিয়ে আসে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রামনে পাকহানাদার বাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। শহরে ফিরে যাবার পথে খানাকুনিয়ারীতেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমনের শিকার হয়। এরপর আবারও ভাগিরথীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর তারা বাগমারাসহ আশপাশের গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমনে হতাহত হয়। এদিন তারা বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। ক্যাম্পে ফিরে ক্যাপ্টেন এজাজকে সবকিছু জানালে এজাজ নিশ্চিত হয় যে, ভাগিরথী মুক্তিযোদ্ধাদের চর, সে ভাগিরথীকে হত্যার নির্দেশ দেয়।

এদিকে ১৩ সেপ্টেম্বর ভাগিরথী শংকিত চিত্তে পিরোজপুর শহরে এসে বাজারের মধ্যে অবস্থান নিয়ে পাকাবাহিনীর গতিবিধির খোঁজ-খবর নিতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যেই হুলারহাটের শান্তি কমিটির শামসুল হক ও আশরাফ হোসেনের মাধ্যমে খবর পেয়ে দু’জন পাকহানাদার ও ৬জন রাজাকার ভাগিরথীকে জোর করে ধরে নিয়ে ক্যাপ্টেন এজাজের সামনে হাজির করে। তথাকথিত শান্তি কমিটির মানিক খন্দকার, দালাল শামসুল হক ও আশরাফ হোসেনসহ অন্যদের সাথে বৈঠকরত ক্যাপ্টেন এজাজ সুবেদার সেলিমকে নির্দেশ দেয় সকলের সামনে ভাগিরথীকে হত্যা করা হোক। এরপর দুজন সিপাহী রশি দিয়ে ভাগিরথীর দুহাত বেধে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয় এবং রশির অপর প্রাপ্ত একটি মটর সাইকেলের সাথে বেঁধে দেয়। পাকআর্মির সুবেদার সেলিম শহরের পীচ ঢালা সড়কে প্রায় দুই কিলোমিটার মটর সাইকেল চালিয়ে ভাগিরথীকে টেনে নিয়ে যায়। এ সময় ভাগিরথীর দেহ থেকে রক্ত-মাংশ রাস্তায় পড়তে থাকে। লাল হয়ে যায় শহরের ব্যস্ততম পিচঢালা রাজপথ। পরে ভাগিরথীর প্রাণহীন নিথর দেহ বলেশ্বর নদে নিক্ষেপ করে।

এ দৃশ্য প্রত্যক্ষদর্শী পিরোজপুর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বর্তমান সম্পাদক তৎসময়ের এস এস সি পরীক্ষার্থী খালিদ আবু বলেন, সাহসী নারী ভাগিরথীকে বক্ষে ধারণ করা বলেশ্বর নদ কুলুকুলু ধ্বনিতে বয়ে যাওয়াকে আজও মনে হয় এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের করুন বিলাপ।

তিনি আরও আক্ষেপ করে বলেন, বিজয়ের দীর্ঘ দিনেও স্বীকৃতি মেলেনি এক অকুতোভয় নারী মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পিরোজপুরের ভাগিরথী সাহার। কার্পণ্য ও হীনমানসিকতার চাদরে ডেকে রাখা হয়েছে ভাগিরথীর স্বীকৃতির সনদ। নেই শহীদ গেজেটের কোথাও তার নাম। শুধু তাই নয় ভাগিরথীর ছেলে কার্তিক যক্ষ্ময় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে। এমনকি চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে ভাগিরথীর দুইটি ছেলেই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত