'এরা সাহসও দেয় না, বিচারও করে না'

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২৩:৩৪

অনলাইন ডেস্ক

"মেয়ে গেল, ছয় মাস অইল। কই, কিছুই তো অইল না। ওরা (সিআইডি) দেখতাছি, খালি দেখতাছি কইতেছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) পাল্টায়। মামলার কিনারা হয় না। নাজমুল করিম (সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার) আমাদের সাহস দিয়েছে। বিচার অইব কইছে। এরা সাহসও দেয় না, বিচারও করে না।", কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নির্মমভাবে খুন হওয়া ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু'র মা আনোয়ারা বেগম।
 
তনু হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস উপলক্ষে কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ। গানে গানে প্রতিবাদী সমাবেশ করেছেন বাউলশিল্পীরা। সমাবেশে কাঁদলেন ও কাঁদালেন তনুর মা আনোয়ারা বেগম। 

তনু হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস উপলক্ষে গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লার উদ্যোগে বাউলদের নিয়ে গানে গানে ওই প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সমাবেশে যোগ দেন তনুর মা আনোয়ারা বেগম ও তনুর ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন ওরফে রুবেল।

সমাবেশে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে কিছু বলার আগেই তনুর মা অঝোরে কেঁদে উঠেন। এ সময় পুরো সমাবেশ স্থলে বেদনাবিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণ পর আবার মাইক্রোফোন হাতে নিলেন। এবারও কাঁদলেন। তাঁর সঙ্গে কাঁদল উপস্থিত প্রতিবাদী জনতা।

আনোয়ারা বেগম বলেন, "মেয়ে গেল, ছয় মাস অইল। কই, কিছুই তো অইল না। ওরা (সিআইডি) দেখতাছি, খালি দেখতাছি কইতেছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) পাল্টায়। মামলার কিনারা হয় না। নাজমুল করিম (সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার) আমাদের সাহস দিয়েছে। বিচার অইব কইছে। এরা সাহসও দেয় না, বিচারও করে না।"

তনুর মা আরও বলেন, "এত কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করলাম। কী হইল? মেয়েকে হারালাম। মেয়েটা পাইতাম না, বিচার চাই। এখন মনে হয় ছেলে দুইটাকে নিয়ে বাঁচতে পারব না। বাসা থেকে বের হলে এফআইয়ের লোকজন ছবি তুলে রাখে। আমি বাইর হতে পারি না। তনুর বাবা অসুস্থ, হার্টের রোগী। মেয়ের কথা যদি খুলে বলতে পারত, তাহলে মনটা শান্তি পেত। আমরারে চাপের ওপর রাহে ওরা। আমি দেশবাসীর কাছে বিচার চাই"।

সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তারা (সিআইডি) বারবার তদন্ত করছে। বিচারটা কি আসলে করব? সবারই ছেলেমেয়ে আছে। ছয় মাস অইল বিচার পাইলাম না।’

তনুর ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখনো হত্যাকারীদের বিচার নিয়ে আমাদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’

আয়োজকেরা জানিয়েছেন, বেলা সাড়ে ১১টায় কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে কুমিল্লার অচিন পাখি বাউলগোষ্ঠীর অন্তত ৪০ জন শিল্পী জড়ো হন। সমাবেশে ডিএনএ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। অন্যথায় আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।

সমাবেশে কুমিল্লার অচিন পাখি বাউলগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা বজলুর বাবুলের নেতৃত্বে ৪০ জন শিল্পী প্রতিবাদী গান করেন। এতে তাঁরা ‘আমরা কি বাংলাদেশের মানুষ না, মানুষ হয়ে তনুর বিচার কেন হবে না’, ‘আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে, কান্দে তনুর মা’ এবং ‘তনু হত্যার বিচার আমরা আজও পাইলাম না’ শীর্ষক তিনটি প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন।

পরে কড়া পুলিশি পাহারায় কান্দিরপাড় পূবালী চত্বর থেকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাউল পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রাটি নগরের কান্দিরপাড়, বাদুড়তলা, ধর্মসাগরপাড়, জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশ দিয়ে নগর উদ্যানে গিয়ে শেষ হয়। পদযাত্রায় অংশ নেন তনুর মা, ছোট ভাই, গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা ও সাধারণ জনগণ। বেলা তিনটায় নগর উদ্যানের জামতলায় তনু হত্যার বিচারের দাবিতে বাউলসংগীত পরিবেশন করা হয়।

সমাবেশে সমাপনী বক্তব্যে গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লার অন্যতম সংগঠক খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, "বিভ্রান্তিকর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুলকে বদলি কিসের আলামত। আমরা ডিএনএ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করার দাবি জানাচ্ছি। তনুর হত্যাকারীদের ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানাই। ছয় মাস পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ আমরা। বিচার না হলে গণজাগরণ মঞ্চের ধারাবাহিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে"।

অচিন পাখি বাউলগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা বজলুর বাবুল ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘মনের গহিন থেকে তানপুরা ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সমাবেশে এসেছি। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে মা জাতির কলঙ্ক থেকে যাবে। বাউলরা মা জাতির কষ্ট মেনে নিতে পারে না।’

উল্লেখ্য, গত ২০ মার্চ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের কালভার্টের পশ্চিম পাশের ঝোপ থেকে কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ২১ মার্চ বিকেলে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের পর হত্যার কথা জানালেও পরে মত বদলায় পুলিশ। বর্তমানে ওই মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।