‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভোটারবিহীন ছিলো না’

প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:০৪

জাগরণীয়া ডেস্ক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উল্লেখ করে বলেছেন, ওই নির্বাচন কোনভাবেই ভোটারবিহীন ছিলো না, যেমন নির্বাচন বিএনপি এবং এরশাদ আমলে এ দেশে হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই একটি কথা আমি জাতিকে বলতে চাই যে, তারা (বিএনপি) যে বলে আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি নির্বিাচন ভোটারবিহীন করেছে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ভোটারবিহীন নির্বাচন ছিলো না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪০ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছিল।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জানুয়ারি (শনিবার) রাতে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভার সভাপতির ভাষণে এ কথা বলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভায় প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ভোট ঠেকানোর জন্য খালেদা জিয়া আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। ৫৮২টি স্কুল পুড়িয়েছে, ভোট কেন্দ্র পুড়িয়েছে, প্রিসাইডিং এবং সহ-প্রিসাইডিং অফিসারকে হত্যা করেছে। তারপর এ দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে এবং ভোট দিয়েছে।

তিনি বলেন, আর দেশের জনগণ ভোট দিয়েছে বলেই কিন্তু আমরা টানা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদেরও ৪ বছর পূর্ণ করতে পারলাম। এরশাদ কিন্তু পারে নাই। এরশাদ ’৮৮ সালে নির্বাচন করেছে এবং ’৯০-এ তার পতন ঘটেছে। খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় টিকতে পারে নাই। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে জনগণের চাপে ৩০ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। মাত্র দেড় মাস তারা ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। কারণ, তারা জনগণের ভোট চুরি করেছিল।’

শেখ হাসিনা বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। কাজেই গণতন্ত্রকে সুরক্ষা করাই আমাদের লক্ষ্য ছিলো। খালেদা জিয়া চেয়েছিল এ দেশে যেন কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া না চলে।

জিয়া এবং এরশাদ দু’জনেই ক্ষমতায় থেকে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শিশু, নারী এবং দেশের রাষ্ট্রপতিকে পর্যন্ত হত্যা করেছে তাদের জিয়াউর রহমান পুরস্কৃত করেছিল বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে। এর পরবর্তীতে যখন জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন তখন জিয়ার মতো ওই একই পন্থায় খুনীদের সংগঠন করার এবং রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হবার অনুমোদন দেন। এরপর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আরো একধাপ উপরে গিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণের ভোট চুরি করে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেন। আর ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল রশিদকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার চেয়ারে বসান। আরেক খুনি হুদা যার ফাঁসি হয়ে গেছে তাকেও সংসদে এনে সেদিন বসায় খালেদা জিয়া।

বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা এখন গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে।

তিনি এ প্রসঙ্গে বিচারপতি সায়েমের নিজের লেখা বই ‘লাস্ট ফেইজ অ্যাট বঙ্গভবন’র উদ্ধৃত দিয়ে বলেন, ‘সায়েম সাহেব ছিলেন প্রেসিডেন্ট। জিয়া সোজা তাকে গিয়ে বলে আপনি অসুস্থ। উনি বলেছেন, আমি অসুস্থ নই। তখন জিয়া অস্ত্র বের করার সাথে সাথেই সায়েম বলেন, হ্যাঁ বাবা আমি অসুস্থ। জিয়া তাঁকে বলেন, লিখে দেন আজ থেকে আমি প্রেসিডেন্ট এবং আপনি পদত্যাগ করলেন। উনি তাই লিখে দিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকলে বিচারপতি সায়েমের বইটি পড়ে নিতে অনুরোধ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া এরপর রেডিও-টিভিতে জেনারেল আইযুব খানের স্টাইলে ঘোষণা দেন, ‘আজ থেকে রাষ্ট্রপতি হলাম। আইয়ুব খানের পদাঙ্ক জিয়া এবং এরশাদ দুজনেই অনুসরণ করেছেন।’

এরা জনগণের কোন্ ভোটে ক্ষমতায় এসেছিল প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যে এখন গণতন্ত্রের কথা বলে তাদের কোন্ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংগঠনের জন্ম?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া ক্ষমতায় গিয়ে আর্মি রুলস অ্যাক্ট ভঙ্গ করে একাধারে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হন। একই অঙ্গে দুই রূপ নিয়ে জিয়া তখন ক্ষমতায় বসেন। সেই অবস্থায় প্রথমে ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোট, তারপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। একতরফা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে তিনি দল গঠন করলেন। 

শেখ হাসিনা বলেন, সামরিক একনায়ক জিয়া যে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সে কথা হাইকোর্টের রায়েও বলা হয়েছে। উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে জিয়া এবং এরশাদের ক্ষমতা দখল অবৈধ, অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক। 

তিনি বলেন, অবৈধভাবে যাদের জন্ম তারা কি করে এতো গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায় সেটাই আমার প্রশ্ন। যাদের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের হাত ধরে। আজকে তারাই গণতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে গেছে। যারা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা এবং একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, আর তারা ক্ষমতা দখল করেই গণতান্ত্রিক হয়ে গেল। 

প্রধানমন্ত্রী দেশের একশ্রেণীর মানুষের আত্মবিস্মৃতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, আমি জানি না দেশের একশ্রেণীর মানুষ কি বিস্মৃতিতে ভোগেন, না আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করাটাই তাদের মজ্জাগত। অথচ এই আওয়ামী লীগই জাতির পিতার নেতৃত্বে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। আর সেটা যদি ওই শ্রেণীর মানুষের দুঃখের কারণ হয় তাহলে আর বলার কিছু নাই। তাদের হৃদয়ে এখনো পেয়ারে পাকিস্তান বিরাজমান, আমরা যেটা মাঝে মধ্যেই টের পাই।

তাঁর সরকারের সময়ে ডিজিটাইজেশনের সুফল প্রত্যেক ঘরে পৌঁছে যাওয়ায় মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেখলাম খালেদা জিয়া টুইট করেছেন, ‘আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে বুলেটে, আর তিনি ব্যালটে বিশ্বাস করেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কথাটা মূলত আমরা যখন গণতন্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর সংগ্রাম শুরু করি সে সময়কার স্বৈরাচার বিরোধী একটা স্লোগান ছিলো।’

তিনি বলেন, তখন আমি বলতাম ‘ক্ষমতা বদলাবে ব্যালটের মাধ্যমে, বুলেটের মাধ্যমে নয়।’ কারণ, বুলেটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিল জিয়াউর রহমান। আর খালেদা জিয়াতো আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে দেশ বিক্রির মুচলেকা দিযেই ক্ষমতায় এসেছে। আওয়ামী লীগ কিন্তু তা কখনো করেনি।

প্রথানমন্ত্রী বলেন, বুলেটের মাধ্যমেই যাদের ক্ষমতা দখল তাদের মুখে এই কথা শোভা পায় না।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় জিয়া পরিবারের দুর্নীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, জনগণের শুধু ভোট নয়, তাদের অর্থ-সম্পদ পর্যন্ত খালেদা জিয়া এবং তার দুই ছেলে লুটে নিয়েছে। এ জন্য তাঁর সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এফবিআই’র তদন্তে বেরিয়েছে খালেদা জিয়ার ছেলে ঘুষ খেয়েছে এবং মানি লন্ডারিং করেছে। সিঙ্গাপুরের আদালতে খালেদা জিয়ার আরেক ছেলের অর্থ-পাচার প্রমাণিত হওয়ার পর সেখান থেকে উদ্ধার করা ঘুষের টাকা দেশেও ফেরত আনা হয়েছে। মানি লন্ডারিং মামলায় তারেকের ৭ বছরের জেল এবং ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় তারেক জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সে অসুস্থতার ভান করে বিদেশে পড়ে থাকছে। দেশে আসছে না। আবার দামী গাড়ি চালিয়ে মাকে নিয়ে যায়। এতো দামি গাড়ি আসলো কোথা থেকে। বাড়ী, গাড়ি, শপিং মল কোন কিছুই তো কম নয়।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তার বাসা থেকে ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি পাওয়া গিয়েছিল বলে মিডিয়ায় প্রচার করা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাঙ্গা স্যুটকেসের যে এতো গুণ তাতো জানা ছিলো না।

মামলায় হেরে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ত্যাগের সময় খালেদা জিয়া যে বিশাল বিত্ত-বৈভব সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছিলেন তা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব দেখলেওতো মনে হয় না যে, শুধু ভাঙ্গা স্যুটকেস রেখে গিয়েছিল জিয়াউর রহমান। নাকি ক্ষমতায় থাকতে লুটের টাকায় এসব করা।

প্রধানমন্ত্রী পুনরায় খালেদা জিয়ার পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে করা- ‘পদ্মা সেতু জোড়া-তালি দিয়ে করা, কেউ পদ্মা সেতুতে উঠবেন না’ মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি এবং বেগম জিয়া এই সেতুতে ওঠেন কি-না সেটা আমরা নজরে রাখবো। জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যই তিনি এটা করছেন বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার জন্য তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে পুনরায় অভিযুক্ত করে বলেন, খালেদা জিয়ার সবকিছুই মিথ্যা, নকল এবং জালিয়াতিতে ভরা।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে ফ্রিগেট ও মিগ-২৯ ক্রয় এবং নভোথিয়েটার নিয়ে বিএনপি’র করা মামলা প্রসঙ্গে বলেন, আমি একটি মামলাও উঠাতে বলিনি বরং বলেছি, সবগুলোর তদন্ত হোক। আর তদন্ত করে কিছুই পাওয়া যায়নি। 

শেখ হাসিনা বলেন, আমি দুর্নীতি করিনি। সে ব্যাপারে আমার সৎ সাহস আছে। যে কারণে পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশি সংস্থার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছি। আর খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়ে মামলায় বার বার রিট করে কেবল কালক্ষেপণ করছেন। আর যেদিনই তিনি আদালতে যাচ্ছেন সেদিনই তার ছাত্রদলের ক্যাডাররা জনগণের সম্পদ গাড়ি ও জানমালের ক্ষতি করছে।

প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীকে শক্তিশালীকরণে তাঁর সরকারের সাবমেরিন ক্রয় নিয়েও বেগম জিয়ার মন্তব্যকে ‘কান্ডজ্ঞানহীন’ বলে সমালোচনা করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত