নারী নির্যাতনকারী পুরুষেরা কতটা সুখী?

প্রকাশ : ০১ মে ২০১৭, ১৭:১৬

জাগরণীয়া ডেস্ক

যেসব পুরুষ নারী নির্যাতন করেন, জীবন নিয়ে তাদের সন্তুষ্টির মাত্রা অন্য পুরুষের তুলনায় কম থাকে। দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া অপর একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা জানাচ্ছে, সমাজে নারী-পুরুষ (জেন্ডার) সমতা এলে নারীর পাশাপাশি পুরুষেরও জীবনযাপনের মান বেড়ে যায়। নারী-পুরুষ সমান সুবিধা ভোগ করেন, এমন সমাজের পুরুষেরা শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে বেশি ভালো থাকেন।

দেশীয় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তাদের গবেষণার শিরোনাম ‘মেনস কোয়ারসিভ কন্ট্রোল, পার্টনার ভায়োলেন্স পারপিট্রেশন অ্যান্ড লাইফ স্যাটিসফ্যাকশন ইন বাংলাদেশ’। বিদেশি গবেষণাটি চালিয়েছেন নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার গবেষণাকেন্দ্রের অধ্যাপক সমাজবিদ অয়েস্টিন গালভ্যাগ হল্টার, যেটির শিরোনাম ‘হোয়াট’স ইন ইট ফর মেন? ওল্ড কোশ্চেন, নিউ ডেটা’।

আইসিডিডিআরবির গবেষণাটি গত বছর প্রকাশিত হয়, যার ফলাফলে দেখা যায়, নির্যাতক পুরুষেরা যদিও মনে করেন, নির্যাতন করার ফলে তাঁরা নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারছেন, কিন্তু অন্য পুরুষদের তুলনায় তাঁদের জীবনের সন্তুষ্টির মাত্রা না বেড়ে বরং কমে। নির্যাতন করার বিষয়টি তাঁদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক প্রভাব ফেলে।

২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত একটি শহর ও একটি গ্রাম এলাকার ১ হাজার ৫৭২ জন পুরুষের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়।

এ গবেষণার একজন গবেষক এবং আইসিডিডিআরবির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট রুচিরা তাবাসসুম নভেদ বলেন, ‘পুরুষ চায় নারী সব সময় অধস্তন থাকবে। সমাজ তা-ই শিখিয়েছে। কিন্তু যখন তা হয় না এবং পুরুষকে নির্যাতনের পথ বেছে নিতে হয়, তখন তা পুরুষেরও আর ভালো লাগে না। পুরুষের ওপর এ জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে বাড়তি চাপ পড়ে।’ এ গবেষণাসহ আরও দেখা গেছে, নির্যাতনের মধ্যে বড় হওয়া ছেলেশিশুদের পরবর্তী জীবনে নির্যাতক হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

রুচিরা তাবাসসুম বলেন, নির্যাতনের ফলাফল পুরুষের জন্যও সুখকর নয়, তা পুরুষকে বোঝাতে হবে। পুরুষের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনতে না পারলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষের সম্পৃক্ততার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে।

গবেষণাধর্মী বেসরকারি সংস্থা এনজিও সেন্টার ফর মেন অ্যান্ড ম্যাসকিউলিনিটিস স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, ‘নারী বাইরে কাজ করছে। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা কমছে না। কারণ, পুরুষ তো মানতেই পারছে না নারী বাইরে কাজ করবে।’

সেন্টার ফর মেন অ্যান্ড ম্যাসকিউলিনিটিস স্টাডিজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ যৌথভাবে দেশের ৩০টি স্কুলে ‘ক্যাম্পাস হিরো ক্যাফে’ নামে একটি সচেতনতামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মুঠোফোনে পর্নোগ্রাফি দেখে শিক্ষার্থীরা যাতে নারী নির্যাতন না করে, সে বিষয়ে কাজ চলছে। এর বাইরে সেন্টার ফর মেন অ্যান্ড ম্যাসকিউলিনিটিস স্টাডিজ পাবনা, রংপুর ও কক্সবাজারে ‘প্রিয় বাবা’ নামের আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মাধ্যমে যে বাবারা পরিবারে নির্যাতন করেন না, মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেন না, সে ধরনের বাবাদের খুঁজে বের করে রোলমডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কথায় আছে, যে ব্যক্তি নিজে ভালো থাকে না, সে অন্যকেও ভালো থাকতে দেয় না। এই ব্যক্তিদের জীবনে সন্তুষ্টির মাত্রায় ঘাটতি থাকে। এ ঘাটতি মনস্তাত্ত্বিক হতে পারে। অতৃপ্তি, হতাশা দেখা দেয়। পারিবারিক সম্পর্কের অসংগতিগুলো খুঁজে বের করতে হবে।’

হল্টারের গবেষণা

নরওয়ের সমাজবিদ অয়েস্টিন গালভ্যাগ হল্টারের ‘হোয়াট’স ইন ইট ফর মেন? ওল্ড কোশ্চেন, নিউ ডেটা’ শীর্ষক গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে।

গবেষণায় হল্টার আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্য এবং ৩১টি ইউরোপিয়ান দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে কম জেন্ডার সমতাবিশিষ্ট অঙ্গরাজ্য এবং দেশ বেছে নিয়েছেন। গবেষণায় উন্নত জীবন বলতে ভালো থাকা, সুখানুভাব, যৌন সন্তুষ্টি, কম বিষণ্নতা, কম আত্মহত্যা, সহিংসতার কারণে কম মৃত্যু বিষয়গুলো বোঝানো হয়েছে।

গবেষণাটি বলছে, সমাজে উচ্চ জেন্ডার সমতা শুধু নারীদের নয়, পুরুষদের জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমেরিকার যেসব অঙ্গরাজ্যে জেন্ডার সমতা কম, সেখানে সূচকে পুরুষদের ভালো থাকার মাত্রা ৩০। অন্যদিকে জেন্ডার সমতা বেশি এমন জায়গাগুলোতে এই মাত্রা ৭০।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, এটা বেশির ভাগ পুরুষই জানেন না, জেন্ডার সমতা তাঁদের জীবনকে আরও উন্নত করে। একজন নারী যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হন, পরিবারে ও সমাজে সব সুযোগ-অধিকার ভোগ করেন; তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পরিবারে এবং সমাজের ওপর পড়বেই। এ জন্য বৈষম্যহীন সমাজের সুফল মানুষকে বেশি বেশি জানাতে হবে।

সূত্র: আমার সংবাদ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত